বাগেরহাট জেলা বিএনপির সদস্য কাজী খায়রুজ্জামান শিপন। দীর্ঘদিন ধরে নানাবিধ অন্যায়-অপকর্মের কারণে তিনি জেলার মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলাবাসীর কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কে হয়ে উঠেছেন। গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকায় গড়ে তুলেছেন ত্রাসের রাজত্ব। দখল ও চাঁদাবাজির জন্য তৈরি করেছেন নিজস্ব বলয়। মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলার শত শত বিঘা মাছের ঘের দখলের অভিযোগ উঠেছে শিপন কাজী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন অনিয়ম ও অভিযোগের অডিও ফাঁস হয়েছে।
শিপন কাজীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তাদের অভিযোগপত্র আমি হাইকমান্ডের কাছে পাঠিয়েছি। তথ্য-উপাত্ত যাচাইবাছাই চলছে। ইতিমধ্যে শিপন কাজীকে শোকজ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি জানান, দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
স্থানীয়রা জানায়, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, প্রশাসন, সরকারি অফিস-সবই শিপনের নিয়ন্ত্রণে। তার রোষানলে পড়ে বিএনপির ত্যাগী অনেক নেতাকর্মীও এলাকাছাড়া। শেখ হাসিনা পতনের পর গত বছরের ১২ আগস্ট দেশে ফিরেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলায় গড়ে তুলেছেন এই মাফিয়া শাসন। জনশ্রুতি আছে, এই আসনে কোথায় কী হবে সবই ঠিক করে দেন শিপন কাজী। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেই প্রতিপক্ষকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে মোবাইলে প্রাণনাশের হুমকি এবং হামলা-মামলা ভয়ভীতি দেখান। সম্প্রতি চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে শিপন কাজীকে দ্বিতীয় দফায় শোকজ করেছে বিএনপি।
সূত্র মতে, দলের স্থায়ী কমিটির এক প্রভাবশালী সদস্যের চাপের কারণে তাকে বহিষ্কারের বদলে বারবার শোকজ করা হয়। বাগেরহাট-৪ আসন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে লিজ দিয়েছেন এবং স্বয়ং খালেদা জিয়া বললেও কাজ হবে না- শিপন কাজীর এমন একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। তাছাড়া শিপন কাজীর বিরুদ্ধে ঢাকার মতিঝিলের ওয়ান ব্যাংকের ঋণ খেলাপীসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর মোড়েলগঞ্জের ১২নং জিউধরা ইউনিয়নের শনিরঝোর-ডেওয়াতলা এলাকায় তানিয়া ইসলামের নামে থাকা ৬০ বিঘা এবং ১৫ বিঘার দুটি মাছের ঘের দখল করে নেয় শিপন কাজী ও তার সহযোগীরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, শিপন কাজী নেতৃত্বে বাগেরহাট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম সোহাগ সরদার, ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি মহিউদ্দিন খান রিপন, রাখি, ইব্রাহিম, মন্টু তালুকদার, আসাদুল, ওসিকুল, সাদ্দাম গংরা অস্ত্রের মুখে তার কাছ থেকে জমির লিজ চুক্তিনামায় সই করিয়ে নিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে ইতোমধ্যে নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৩০ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে বিকাশের মাধ্যমে দিয়েছি। তিনটি ঘেরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ভুক্তভোগী তানিয়া ইসলাম জানান, ১৯৮৮ সাল থেকে নিজস্ব জমিতে ঘের করে আসছেন তার পরিবার। ঘের দখলের ঘটনায় শিপন কাজী ও তাদের সহযোগীদের নামে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বাগেরহাট জেলা বিএনপি ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ঢাকার তিনটি থানায় আমার নানা ও দুই মামার নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে শিপন কাজীর সহযোগীরা।
জিউধরা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলামের বাড়িঘর ভাঙচুর ও ১৭ বিঘা মাছের ঘের লুটপাট চালিয়েছে শিপন কাজী ও তার সহযোগীরা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে এলাকায় থাকতে পারলেও বর্তমানে আমি পরিবার নিয়ে ঘরছাড়া। অথচ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শিপন কাজীর সঙ্গেই রাজপথে আন্দোলন করেছি। শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়িয়ে এখন বিএনপির লোকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছেন তারা। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, জিউধরা ইউনিয়নের শুধু এই দুই ঘের নয়, মৌলভীবাজার টু ঘরামী বাজারের মাঝে পারভেজ মৃধার ৭০ ও ৫০ বিঘার দুইটি ঘের, ইমরান খানের ১৯০ বিঘা, মাহবুব খানের ৭৫ বিঘা এবং সাইদুল মেম্বারে ২০ বিঘার ঘেরের মাছ লুটসহ দখল করে নিয়েছে শিপন কাজীর অনুসারীরা। এসব ঘেরে তিন থেকে চার কোটি টাকার মূল্যের মাছ ছিল। শিপন কাজীর এপিএস বদর শিকদার, ইউনিয়নের সভাপতি কামাল খান, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হাওলাদার, দাউদ মৃধা, লোকমান তালুকদার, গিয়াস মৃধা, সোহেল তালুকদার, আলতাফ খান, বাচ্চু মৃধা, জুলহাস, কামাল ঘরামী, রুবেল হাওলাদার, মুকুল খান, কামাল খান গংরা এসব ঘের দখল করেছে। এদের মধ্যে দাউদ, গিয়াস ও সোহেল আওয়ামী লীগ থেকে রাতারাতি বিএনপি হয়ে যায়। আর এদের শেল্টারদাতা শিপন কাজী। জমির প্রকৃত মালিকদের হারির (লিজ) টাকাও দেয়নি। হামলার ভয়ে কেউই প্রকাশ্য মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহরবুনিয়া ইউনিয়নের রিপন তালুকদার চেয়ারম্যানের ৮০ বিঘা, মিলন তালুকদারের ১০০ বিঘা, আলি ফরাজী ৬০ বিঘা, রফিকুল ফরাজী ৫০ বিঘা, মামুন শেখ ৪০ বিঘা, মাসুদ ৮০ বিঘা তরিকুল ইসলাম গোলাপের ১০০ বিঘা, বয়াসিংগার মোস্তফার ২২ বিঘা এবং রুম্মানের ৬৫ বিঘা মাছের ঘের লুটপাটসহ দখল করে নিয়েছে শিপন কাজীর অনুসারী। বহরবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি নজরুল ইসলাম, কৃষকদলের আহ্বায়ক মাসুম হাওলাদার, সাবেক ছাত্রদলের সভাপতি নাজমুল ইসলাম রাকির নেতৃত্বেই এসব ঘের দখল হয়েছে। এছাড়া রারইখালি ইউনিয়নে সুমনের ৩০ বিঘার ঘের জোর করে দখল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শিপনের অনুসারী রিপন খান ও কামাল খানের বিরুদ্ধে। তবে হামলার ভয়ে এসব ঘের মালিকরা মুখ খুলতে বা থানায় অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন। এছাড়াও মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলায় বেশির ভাগ ঘেরই বর্তমান দখল হয়ে গেছে। আবারও অনেকেই চাহিদা মতো টাকা দিয়েও এলাকা ছাড়া।
এদিকে শিপন কাজী মোবাইলে ফোনে ২০ লাখ টাকা চাঁদা ও মাসিক মাসোহারা দাবি করেছেন গ্রিসের বাঙালি কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক এবং ‘জাহিদ ইসলাম’ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাহিদ ইসলামের কাছে। তার রেকর্ড রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে। ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি দুই দশক ধরে গ্রিসে থাকি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। গ্রিসের একটি বাঙালি কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক দায়িত্বে থাকায় নানা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন শিপনের অনুসারীরা। অথচ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেই আমার বেশি ছবি রয়েছে।’
জাহিদ ইসলাম জানান, শিপন কাজীর ভয়ে দেশে এসেও অসুস্থ বাবা-মায়ের সঙ্গেও দেখা করতে পারিনি। সর্বশেষ আব্বা-আম্মার দোয়া মাহফিলের খাবারও ফেলে দিয়েছে। তাকে মোবাইলে ফোনেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি বাগেরহাটের এসপিকে জানিয়েও প্রতিকার পাইনি। পরে এসব অভিযোগ লিখিতভাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
মোড়েলগঞ্জ উত্তর সুলতাড়ি শফিজউদ্দিন দাখিল মাদ্রাসায় ১৪ লাখ চাঁদাবাজির অভিযোগ ও হামলা ঘটনায় শিপন কাজীসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মাদ্রাসার সুপার এম জহিরুল আলম। ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর বাগেরহাট জেলা জজ আদালতে এই মামলা করা হয়েছে। জহিরুল আলমের কাছে চাঁদা দাবি ও মারার হুমকি দেওয়ার কল রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
অপরদিকে শরণখোলার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের পর শরণখোলায় সুন্দরবন এলাকায় শিপন কাজীর সহযোগী শরখোলা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আনোয়ার পঞ্চায়েতের গ্রুপের নেতৃত্বে বিভিন্ন চর দখলে নিয়েছে। এর মধ্যে ইলিশাচর, ছাপড়াখালী, খেলারচর, কটকা, কচিখালী- এসব অভয়ারণ্যে চর ও জেলেরা তাদের নিয়ন্ত্রণে।
স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, জিউধারা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর বাদশা ও শিপন কাজী সম্পর্কে বেয়াই। তার চাচাতো ভাই যুবলীগ নেতা কাজী সাইফুজ্জামান রাসেল। এদের হাত ধরেই আওয়ামী লীগের মতিউর রহমান বাচ্চুসহ অনেকেই এখন বিএনপিতে যোগ করেছেন। নব্য বিএনপির দাপটে অনেক সিনিয়র নেতারা চুপ হয়ে গেছেন। অথচ ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন শিপন। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির নেতারা জেলে থাকলেও তিনি ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে বাড়িতে আসতো। সামনে-পেছনে পুলিশ র্যাবের গাড়ি থাকতো। অবশ্য তারা এও বলেন, সারাদেশে চাঁদাবাজি-দখলের বিরুদ্ধে হাইকমান্ড ব্যবস্থা নিলেও শিপনের বিরুদ্ধের অভিযোগ থাকলেও অদৃশ্য শক্তিতে তা আটকে যায়।
মোড়েলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মতলুবুর রহমান বলেন, এই এলাকায় দখল-বেদখল চলে। কিছু অভিযোগ শুনেছি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
শিপন কাজীর দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আকরাম হোসেন তালিম। তিনি বলেন, ‘দপ্তর থেকে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা শিপন কাজীকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু কী কারণে হাইকমান্ড ব্যবস্থা নেয়নি তা জানি না।’
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সমন্বয়ক এম এ সালাম বলেন, ‘মোড়েলগঞ্জের দুই-একটা অভিযোগ আসছিল। আমি বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
বিএনপির গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম বলেন, ‘যারা চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ও দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে বাগেরহাট জেলা বিএনপির সদস্য খায়রুজ্জামান শিপন বলেন, ‘কোথাও আমার একটাও মাছের ঘের নাই। আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির লোকজনের ঘের দখল হয়েছিলো সেইগুলা বিএনপি ও সাধারণ মানুষ উদ্ধার করেছে। এখানে আমার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নাই। একটা কুচক্রী মহল আমার বিরুদ্ধে রাজনীতিতে অবস্থান নিতে না পেরে এগুলো প্রচার করছে।’
তিনি বলেন, সামনে আমি নমিনেশন চাইব। বিএনপির আরেকটা গ্রুপ আছে যারা এলাকায় যায় না, কাজ-কাম করে না, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তারা বিএনপিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে নীলনকশায় নামছে। তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা রটাচ্ছে ও ষড়যন্ত্র করছে।
মাদ্রাসার সুপারকে চাঁদা দাবি ও হুমকি দেওয়ার বিষয়ে শিপন বলেন, ‘এই মাদ্রাসায় আমার বাপ-দাদার ২০ বিঘা সম্পত্তি দেওয়া। আমার দাদার নামে মাদ্রাসা। মাদ্রাসার প্রধান ওলামা লীগের সদস্য। প্রভাব খাটিয়ে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগের লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছে। মাদ্রাসা শেষ করে দিয়েছে এখন কোন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয় না।’ প্রবাসী জাহিদের বাড়িতে হামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা নিজেরা বাড়িতে হামলা করে বিভিন্ন মিডিয়ায় নিউজ করিয়েছে। এর সঙ্গে আমি কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই।’
মন্তব্য করুন