সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য একটি সুষম ও মর্যাদাসম্পন্ন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নসহ ১২ দফা দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)।
রোববার (৫ অক্টোবর) বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ইউট্যাবের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, মহান দিবসে আমরা জাতি গঠনের স্থপতি, জ্ঞানের দীপশিখা জ্বালানো সর্বস্তরের শিক্ষক সমাজকে ইউট্যাব’র পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষকতা পেশা : মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আজকের দিনটি শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ও পেশাগত অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের সাথে উল্লেখ করছি যে, এই দিবস এমন এক সময়ে পালিত হচ্ছে যখন বাংলাদেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষকই পেশাগত অবমূল্যায়ন ও আর্থিক সংকটসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা সংক্ষেপে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের সেই বাস্তবতার কিছু চিত্র আপনাদের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরছি এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের কাছে কিছু দাবি জানাচ্ছি।
ড. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার ভিত্তি তৈরির মূল দায়িত্বপালন করেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা। অথচ এই দুই স্তরের শিক্ষকদের বেতন-ভাতাদি জাতীয় বেতন স্কেলে নিম্ন স্তরে আটকে আছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ লাভ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্বনিম্ন। এমনকি বাংলাদেশের সমযোগত্যার অন্য চাকুরিরতদেরও বেতন স্কেল প্রাথমিক শিক্ষকদের তুলনায় বেশি।
তিনি বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ বেতন ও অন্য পেশাগত সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তিতে চরম বৈষম্যের শিকার। দেশের মাধ্যমিক স্তরের ৯৭ ভাগ শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে। এতে কর্মরত বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। তারা নাম মাত্র বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়নি। অবসরের পর তারা যৎসামান্য যে অবসর ভাতা ও কল্যাণ তহবিল থেকে অর্থ লাভ করেন, তাও সরকার সময় মতো পরিশোধ করে না। ফলে অবসরের পর একজন শিক্ষককে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসার শিক্ষকগণও একই দুরাবস্থার মধ্যে আছেন।
ইউট্যাবের প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে সকল বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স চালু আছে, সেখানে কর্মরত শিক্ষকদের এখন পর্যন্ত এমপিওভূক্ত করা হয়নি। আমরা মনে করি, শিক্ষকদের প্রতি সরকারের এটি চরম বৈষম্যমূলক নীতি। অনার্স এবং মাস্টার্সের পাঠদানের দায়িত্ব শিক্ষকদের উপর ন্যস্ত করা হলেও সরকার তাদের কোনো আর্থিক দায়িত্ব নিচ্ছেন না, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তিনি বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষকগণ অন্য সমযোগ্যতার সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় কেবল আর্থিক সুযোগ সুবিধায়ই পিছিয়ে নন, পদোন্নতি প্রক্রিয়ায়ও তারা চরম বৈষম্যের শিকার। দীর্ঘদিন একই পদে চাকরি করেও নানা জটিলতার কারণে শিক্ষকরা সময়মত পদোন্নতি পাচ্ছেন না। শিক্ষকদের উপর প্রশাসনিক কাজ, নির্বাচন ও সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নের চাপও অত্যধিক। কিন্তু এর জন্য তাদের কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। এমনকি শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি, ডিজিটাল শিক্ষণ প্রযুক্তি ও গবেষণায় প্রশিক্ষণের সুযোগও সীমিত।
অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম বলেন, এতক্ষণ আমরা প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থাও একই রকমের নাজুক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশের উচ্চশিক্ষার মূল কারিগর হলেও অন্য সরকারি ক্যাডারের তুলনায় তারা আর্থিক সুবিধাদি লাভে পিছিয়ে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত গবেষণা তহবিল নেই, ফলে যোগ্য শিক্ষক ও গবেষক থাকলেও বিশ্বমানের গবেষণার সুযোগ তারা পান না। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। শিক্ষকগণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ হারিয়েছেন। এমনকি রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়ে শুধু পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়া নয়, অনেকে চাকুরিচ্যুতও হয়েছেন। এতে শিক্ষকদের কর্মউদ্দীপনা নষ্ট হয়েছে এবং কাক্সিক্ষত সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে অনেক মধাবী শিক্ষক বিদেশমুখী হয়েছেন। আমাদের দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ইতোমধ্যে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের অবস্থাও হতাশাজনক। তাদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই, বেতন কাঠামো অসংগতিপূর্ণ এবং গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত।
উপর্যুক্ত অবস্থার প্রতিকারে আমাদের দাবিসমূহ
১. জাতি গড়ার কারিগর সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য একটি সুষম ও মর্যাদাসম্পন্ন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হবে;
২. শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী করতে হবে;
৩. শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, গবেষণা সুযোগ ও ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে;
৪. শিক্ষকদের প্রকৃত শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করার জন্য প্রশাসনিক কাজ কমিয়ে আনতে হবে;
৫. সকল স্তরের বেসরকারি শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করতে হবে এবং অবসর গ্রহণকারী বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধাসহ সকল পাওনা অবিলম্বে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে;
৬. আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র, মর্যাদাপূর্ণ ও উচ্চতর বেতন স্কেল প্রবর্তন করতে হবে;
৭. শিক্ষকদের গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে গবেষণা ভাতা প্রদান করতে হবে;
৮. পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও গবেষণার মানোন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিবছর ন্যূনতম ১ টি আন্তর্জাতিক ও ১ টি জাতীয় পর্যায়ে কনফারেন্স/সেমিনারে অংশগ্রহণ ও গবেষণাপত্র উপস্থাপনের জন্য ভ্রমণ ভাতাসহ অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে;
৯. উন্নতমানের জার্নালে গবেষণাপত্র ও স্বীকৃত মানের গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে;
১০. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তা, বেতন কাঠামো নির্ধারণ ও গবেষণা সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে;
১১. বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ অবারিতকরণসহ শিক্ষা ও গবেষণা বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে;
১২. শিক্ষকদের সম্মান, সামাজিক মর্যাদা ও কর্মক্ষেত্রে সকল প্রকার অনিশ্চয়তা দূর করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ড. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর, গবেষণামুখী ও নৈতিকভাবে সচেতন একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা টেকসই উন্নয়নের মূলশর্ত। আর একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরির মূল কারিগর হলেন শিক্ষক। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকরা আজ অর্থনৈতিক অনটন ও পেশাগত অবমূল্যায়নের কারণে হতাশ। এ অবস্থার উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল স্তরের শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা, পেশাগত সুযোগ-সুবিধা এবং উপযোগী কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। এ জন্য আমরা সরকারের সদর্থক পদক্ষেপ, নীতি সংশোধন এবং যথাযথ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইউট্যাবের মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল কালাম সরকার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক কামরুল আহসান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক লুৎফর রহমান, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সোহাগ আউয়াল, ইউট্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আবদুর রশিদ, সহসভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, ইউট্যাবের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম, অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন, অধ্যাপক মেহেদী হাসান খান, অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী, অধ্যাপক ড. আব্দুল করিম, অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম রুবেলসহ অনেকেই।
মন্তব্য করুন