১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। ওইদিন খুনিদের দিকবেদিক ছোঁড়া কামানের গোলায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শেরশাহ সুরী রোডের ১৩ জন নিহত হন।
এ ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলার অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে ১৭ আসামির বিচার শুরু হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুন্সী আতিকুর রহমান আদালতে সাক্ষ্য দেন। এ নিয়ে মামলায় ৫৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়। পরে গত সাড়ে চার বছরের আর কোনো সাক্ষ্য হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এতে এ মামলার বিচার কাজ আটকে রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু কালবেলাকে বলেন, ‘এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। দ্রুত এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করা হবে। পরবর্তী কার্যক্রম শেষে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হবে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে।
লেফট্যানেন্ট কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যায়। প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে।
নিহতরা হলেন- রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।
ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমান। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার ১৩তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সর্বশেষ গত ২১ জুন এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। তবে সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় আগামী ১ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন রয়েছে।
এ মামলার ছয় আসামিকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তবে এ মামলায় এখনো দশ আসামি পলাতক রয়েছে।
ফাঁসি কার্যকর হওয়া আসামিরা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ ও ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ। ওই ছয় জন ছাড়া এ মামলায় তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। এ মামলায় এখনো দশ আসামি পলাতক রয়েছে। তারা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ইবি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর আহম্মদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন কিসমত হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অব.) মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফ আলী শাহ ও এলডি মোহাম্মদ আবুল হাসেম মৃধা।
এ মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী দুই বছর আগে মারা গেছেন জানিয়ে তার স্ত্রী শাহানাজ বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘এ মামলাটি পরিচালনা করতে গিয়ে আমার স্বামী অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন। তার বিচার দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তিনি তো আর দেখতে পারলেন না। এখন এ মামলার বিচার দ্রুত শেষ করা হোক সেটায় চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কিভাবে আছি, কেউ খোঁজ নেয় না। বাবার বাড়িতে দুই সন্তান নিয়ে নিরুপায় হয়ে জীবনযাপন করছি। প্রতিবছর সাংবাদিকরা এসে দেখে যায়, ভিডিও করে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের জন্য কিছুই হয় না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাওয়া আমাদের যেন থাকার কোন ব্যবস্থা করে দেন।’
মন্তব্য করুন