

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যৌথভাবে নয় দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি। এর মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মূল আট দফা দাবি রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে অন্তত এক মাস সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় সেনা ও বিশেষায়িত বাহিনী মোতায়েন নিশ্চিত করা অন্যতম।
শনিবার (০৬ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় সংগঠন দুটির পক্ষে লিখিত বক্তব্যে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব এসব দাবি জানান। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নির্বাচন নিয়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অতীত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত বেদনার, একই সঙ্গে উদ্বেগ ও শঙ্কার। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে প্রত্যেকটি নির্বাচনে, নির্বাচনের আগে ও পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে। সব নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে। সম্প্রদায়গত ঘৃণা, বিদ্বেষ প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা করেছে। নির্বাচনে পরাজিত দল হামলা-নির্যাতন করে, কিন্তু এ-ও দেখা গেছে বিজয়ী দলও হামলা করে। আর নির্বাচনে হামলার মুখ্য শিকার হয় প্রধানত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা।
এতে আরও বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করে বয়ান প্রকাশ এবং সভা-সমাবেশে, বিশেষ করে ধর্মীয় সমাবেশে বিদ্বেষ ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সব সময় এক শঙ্কার মধ্যে রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। নির্বাচন এলে তা আরও বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, বিশেষ করে ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে শঙ্কা ও অনীহা তৈরি করে। এ ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
৯ দফা দাবি হলো : এক. মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় যুগোপযোগী সংস্কারসহ বাহাত্তরের সংবিধান হবে আগামী দিনে রাজনীতির মূল ভিত্তি। দুই. রাজনীতি ও সব নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকবে। ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে হবে। তিন. জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। দলীয় কাঠামোতেও যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত থাকতে হবে। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধনের সময় আইনগত বাধ্যবাধকতার বিধান করতে পারে। চার. জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাপর অন্তত এক মাস ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় সেনা ও বিশেষায়িত বাহিনী মোতায়েন নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনেও নিরাপত্তায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাঁচ. জীবন-জীবিকার সব পর্যায়ে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বৈষম্য নিরসন করতে হবে। ছয়. গণঅভ্যুত্থানের পর সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যাদের নির্বিচারে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে পুনর্বহাল করতে হবে। সাত. বাড়িঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, জায়গা-জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। চাঁদাবাজি বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আট. গণঅভ্যুত্থানের পর ব্যাপক হারে ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয় থেকে তা স্বীকৃত হয়েছে। এসব মামলায় ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিদ্বেষপ্রসূতভাবে জড়ানো হয়েছে। কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। অবিলম্বে এসব মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে। নয়. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মূল আট দফা দাবি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে অঙ্গীকার ঘোষণার মাধ্যমে সম-অধিকারের চেতনার প্রতি অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংকটের একমাত্র সমাধান নতুনভাবে বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করা। এ জন্য আগে মানুষ হতে হবে। জনগণের ক্ষমতা-অধিকার তাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। এই দেশ আমাদের সবার। রাষ্ট্র কারো অধিকার হরণ করতে পারবে না। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে তিনি খুব বেশি আশাবাদী না। বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার হচ্ছে; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো কোনো সংস্কার হয়নি, আচরণেও তেমন পরিবর্তন হয়নি।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, চব্বিশের ৫ আগস্টের পরে নানাভাবে সংখ্যালঘুদের ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। নানা ঘটনায় মামলাও দেয়া হয়েছে। এমন একটা অবস্থার মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। আশা করেছিলাম, সরকার পদক্ষেপ নিবে। একমাত্র সেনাবাহিনী আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে আমরা সেভাবে সহযোগিতা পাচ্ছি না। নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভয়-ভীতির মধ্যে রয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এই সরকার কোথাও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব রাখছে না। আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়েও সরকারে সেভাবে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চর্চা ডটকমের সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, দেশে সংখ্যালঘুরা এখন এতটাই নিরুপায় যে, একজনকে ধর্মভিত্তিক একটি দলে গিয়ে নির্বাচন করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য সবার দায় রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ধর্ম অবমাননায় মামলার শিকার হয় সংখ্যালঘুরাই। অন্য ধর্মের কারো বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা হয় না। সংখ্যাগুরুদের জন্য পাহারারও প্রয়োজন হয় না। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, সমাজ ক্রমেই বিভক্ত হয়ে পড়ছে। যথাসময়ে নির্বাচন না হলে দেশ মহাসংকটে পড়তে পারে। তাই নির্বাচনটা প্রয়োজন। জনগণ চায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ফিরে আসুক।
ফিন্যান্সিয়াল পোস্টের সম্পাদক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এমএ আজিজ বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রয়োজন, না হলে সবার অধিকার সমান হবে না।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্নভাবে নির্যাতন-হয়রানির শিকার হচ্ছে। নির্বাচনের পূর্বাপর এটা আরও বাড়ে। একইসঙ্গে তারা বৈষম্যেরও শিকার। এই পরিস্থিতির অবসান চান তারা।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দারের সঞ্চালনায় সভায় এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ, রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক মেজর (অব.) নাসির, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ বক্তব্য দেন।
মন্তব্য করুন