বিশেষ প্রতিনিধি
০৬ জুন ২০২৩, ০৫:১৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘প্রধানমন্ত্রীর সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিয়েছে’

মোহাম্মদ এ আরাফাত গবেষক, সমাজচিন্তক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা রেস্ট্রিকশন, জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, অর্থনৈতিক সমস্যাসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।

কালবেলা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি আগামী নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: ভিসা আমেরিকানরা কাকে দিবে কাকে দিবে না, এটা তাদের এখতিয়ার। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু তারা যখন এটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটা বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে তখন সেটিকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি না, আবার আমরা এটিকে প্রত্যাখ্যানও করছি না। যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যগুলো যদি দেখেন তাহলে দেখবেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যে অঙ্গীকার করেছেন সেটি যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিয়েছে। এখানে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই। আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই এবং সে লক্ষ্যেই তারা এ ভিসানীতিটি দিয়েছে। এখন যারাই নির্বাচন নিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে তারাই বিপদে পড়বে। আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত না, আমাদের অঙ্গীকার আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই।

কালবেলা: অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বা অন্যান্য দেশ থেকে আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: যুক্তরাষ্ট্র যখন র‍্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা দিল তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছে। তারা বলেছেন, আরও নিষেধাজ্ঞা আসছে। কিন্তু আসেনি। আন্দাজ করে অনেকে অনেক কথাবার্তা বলেন। অনেকে গুজবও ছড়ানোর চেষ্টা করে। আমরা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে আছি। ইউরোপিয়রা কোনো নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছে না, এমনকি তাদের ভাবনার মধ্যেও নেই, চিন্তার মধ্যেইও বিষয়টি নেই। কাজেই সহসা নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আসার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশকে আমেরিকা, ইউরোপ এমনকি সারা পৃথিবীর লাগবে। বাংলাদেশকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা স্বীকার করছি আমাদের সমস্যা আছে এবং এটাকে আমরা সমাধান করতে চাই। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পরে সামরিক শাসকরা এসেছে। তাদের মধ্য থেকে আবার নতুন দল গজিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে। এসব কারণে রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় এসে মাত্র ১৪ বছরে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে না। আমাদের হাত ধরে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে- আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আওয়ামী লীগের চিন্তাধারা সবকিছু ঠিক করা। আরো ভালো কাজ করা। যে কাজ করে ভুল তারই হয়, আর যে কাজ করে না তার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাজ করেছে এবং করছে, তাদের আরও সময় দিতে হবে। দেখতে হবে তাদের চিন্তা ও মানসিকতা কেমন। আমরা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি মানুষকেন্দ্রিক।

কালবেলা: আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর তৎপরতা এবার একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে বিভিন্ন ইস্যুতে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এতে আওয়ামী লীগ কি কোনো চাপ বোধ করছে?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নই। কারণ, বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ এ দেশ স্বাধীন করেছে। এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা খোদ এ দলের দায়িত্বে আছেন এবং দেশ চালাচ্ছেন। বাংলাদেশের জন্য কার দরদ বেশি? মায়ের চেয়ে মাসির দরদ কি বেশি হয়? বাংলাদেশকে একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এ দেশে গণতন্ত্র জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই এসেছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে শুরু করে অন্যান্য যে চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো আমরা তার নেতৃত্বে মোকাবিলা করব। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে যে, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি সবসময় উন্নয়ন ও সংস্কারকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখতে চায়। আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। এখানে বিরোধী পক্ষ সবসময় মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। বিএনপির বন্ধুত্ব অনেক বেশি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির সঙ্গে এবং তাদের রাজনীতির মধ্যে কোনো সততা নেই। আমরা যদি ভালো বিরোধী দল পেতাম, তাহলে আওয়ামী লীগ আরও ভালো কাজ আরও বেশি করতে পারত।

কালবেলা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে প্রচলিত গণতন্ত্রের যে পন্থা যেটা পুরো বিশ্বে আছে এমনকি পাশের দেশ ভারতেও আছে সেটাতে যেতে চায়। এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স করেছে, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করেছে, ইলেকশন কমিশন গঠন আইন করেছে। এ সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে এবং আমি বিএনপিকে আহ্বান জানাব তারাও আরও কিছু সমাধান দিক। আমরা সারাজীবন বাঁচব না। কিন্তু বাংলাদেশ থাকবে। আমরা একটা সমাধান দিয়ে যেতে চাই, যাতে অনন্তকাল ধরে গণতন্ত্র টেকসইভাবে চলতে পারে। আওয়ামী লীগ সেটা করে যাচ্ছে কিন্তু বিরোধীপক্ষের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে না।

কালবেলা: আওয়ামী লীগের মধ্যেই নানা দ্বন্দ্ব ও পাল্টা নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছে। এটি কি কোনো অশনিসংকেত?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: বর্তমানে বিরোধীদলের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তারা অতীতে সরকারে থাকা অবস্থায় যে অপকর্ম; ২১ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটানো, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় অগ্নিসন্ত্রাস, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার যে অপচেষ্টা, জঙ্গিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করা—এসব করে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও তাদের অবস্থান এমন তলানিতে পৌঁছে গেছে- যে কারণে তারা আসলে কোথাও নাই। এখন তারা নির্বাচনকে বয়কট করার রাস্তায় গেছে। যে কারণে আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এটা ভালো। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য হয়তো কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে কিন্তু আবার যদি অন্য কোনো প্রতিপক্ষ চলে আসে তাহলে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে। এটাই আওয়ামী লীগের শক্তির জায়গা। পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখবেন বিভিন্ন যৌক্তিক বা অযৌক্তিক করাণে হয়তো কিছু হতাশা কাজ করে কিন্তু নির্বাচনের ছয় মাস আগে সবাই সোজা হয়ে যায়,একাট্টা হয়ে যায়-এটাই আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এটা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। ওই শক্তি যেখানে আছে সেখানে আমরা চিন্তিত না। অনেকে বলছেন, প্রতিপক্ষ তৈরি করা হচ্ছে যেন আগামী নির্বাচনে যেন অন্তত দুইটা প্রার্থী থাকে।

কালবেলা: বিএনপি না আসলে অন্য সব দল নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর কোনো চিন্তা আছে কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: আওয়ামী লীগ অনেক বড় একটি দল। তারা যাকে নৌকা দেবে এবং এর বিপরীতে দল থেকেই স্বতন্ত্র হিসেবে যিনি দাঁড়াবেন তারও বড় জনসমর্থন থাকে। অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীও জিতে যাবে। এটাই আওয়ামী লীগ। ভোট পড়ার জন্য বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দরকারই নেই। গাজীপুর হচ্ছে তার উদাহরণ সেখানে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে আওয়ামী লীগ দল থেকেই স্বতন্ত্র নির্বাচন করার জন্য ছেড়ে দিবে। আওয়ামী লীগের যারা নোমিনেটেড হবে এবং যারা নোমিনেটেড হবে না তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে এটা ভালো। এরপর অন্যান্য দলের যারা প্রার্থী আছে তারাও দাঁড়াবে। নির্বাচনে বিএনপির কোনো অভাব কেউ মনে করবে না।

কালবেলা: বিএনপি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না। কারণ প্রশাসনে সব আওয়ামী লীগের মানুষ বলে তাদের অভিযোগ। সেক্ষেত্রে বিএনপির আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগ কী করছে?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: যদি যৌক্তিকভাবে চিন্তা করি তবে আওয়ামী লীগের একটা দায় আছে বিএনপির মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করার। কিন্তু বিএনপির ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি করা খুবই কঠিন। তারা সারাজীবন ভোট চুরি করার চেষ্টা করেছে। কাজেই চোরকে বোঝানো কষ্ট যে চুরি হবে না। এখন তো তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছে। তাদের সুযোগ দিলে তারা আবার ভোট চুরি করার চেষ্টা করবে। আমি মনে করি, দেশের মানুষকে, জাতিকে এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু এ কাজটি শেখ হাসিনাকে একা করতে হচ্ছে। তাই বিএনপিকে বোঝাতে না পারলে বোঝানো দরকার নেই। দেশের জনগণ ও বিশ্বকে যদি বোঝাতে পারি এবং প্রমাণ দিতে পারলেই হবে।

কালবেলা: নির্বাচন সামনে রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অপব্যবহারও হয়েছে কিছু কিছু,যা আইনমন্ত্রীও শিকার করেছেন...

মোহাম্মদ এ আরাফাত: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে যদি কোনো ফাঁকফোকর থাকে, অপব্যবহার করার সুযোগ থাকে তাহলে সেটাকে সংশোধন করতে হবে—এটার পক্ষে আমিও। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, এই আইনকে আরও উন্নত করা দরকার। একটা আইন তৈরি করার পর কোথায় কোথায় এর অপব্যবহার হচ্ছে সেটি দেখার বিষয় আছে। এটা সমাজে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। এটা ঠিক করার সুযোগ আছে। এই আইনের মধ্যে কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো আরও উন্নত করা দরকার। এটা সত্যি যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিজিটাল আইনের অপব্যবহার হচ্ছে যেটা আইনমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন, সেটা আটকানো জরুরি। শুধু এই আইন না যে কোনো আইনের অপব্যবহার রোধ করতে হবে, এটা সভ্যতার দাবি, গণতন্ত্রের দাবি। এটা আমাদের করতেই হবে।

কালবেলা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম সফলতা হচ্ছে অর্থনৈতিক সূচকে ভালো করা, এটা সবাই কমবেশি বলছে। কিন্তু এখন এসে কিছু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকে। আপনার কি মনে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে এগিয়ে যেতে হলে বড় সংস্কার প্রয়োজন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে না। যদি দেখা দিত তাহলে কোভিডের আগেই দেখা দিত। সমস্যা দেখা দিয়েছে কোভিড এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে। যদি অর্থনৈতিক ইকুয়েশন থেকে কোভিড এবং যুদ্ধ বাদ দেয়া হয়, তাহলে অঙ্ক করে দেখিয়ে দিতে পারব আজকে আমাদের রিজার্ভ কত থাকত, প্রবৃদ্ধি কত থাকত এবং অর্থনীতি কোথায় থাকত। কাজেই এই কথা যারা বলতে চান, তারা একটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলো বলে থাকেন। বরং কোভিড এবং যুদ্ধ থাকার পরেও পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো জায়গায় আছে। এটা সম্ভব হয়েছে পূর্বে আমাদের অর্থনীতি ভালো একটি অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল বলেই। অর্থপাচার নিয়ে আমি গণমাধ্যমকে বলব, আরও একটু প্রপার ইনভেস্টিগেশন করতে। অর্থপাচার নিয়ে যত স্টেটমেন্ট আসছে, তার সবই মিথ্যা। সিপিডিও মিথ্যে কথা বলেছে। আমি এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করে বলছি, তারা মিথ্যা বলেছে। সিপিডি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তারা কেন আন্দাজ করে কথা বলবে? তারা ফ্যাক্টস নিয়ে কথা বলবে। সিপিডি মূলত সস্তা পপুলারিটি নেওয়ার জন্য এই কথাগুলো বলছে।

বাংলাদেশে অর্থপাচার পৃথিবীর অন্য দেশের চেয়ে কি বেশি হয়? সিপিডি যে পরিসংখ্যানটি দেয়, তারা সেটি কোথায় পায়? তাদের নিজেদের কোনো স্টাডি আছে? একটাও নাই। তারা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্টের স্টাডি নিয়ে এসে এটাকে মিস ইন্টারপ্রিয়ট করে প্রচার করে, সস্তা জনপ্রিয়তা নেয়ার জন্যে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি তাদের রিপোর্টে কোথাও বলেনি, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। তারা একটি এস্টিমেট দেয়, যেটাকে বলে ‘পটেনশিয়াল মিস ইনভয়েজিং’। মানে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর কত শতাংশ সত্যিকার অর্থে পাচার হয়েছে, তার তথ্য গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির কাছে নেই। আর সিপিডির কাছে তো নাই-ই। এখানে তারা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য এটি করছে। জিএফআইর প্রকৃত প্রতিবেদন পড়ে দেখেন, দেখবেন ওই লেভেলে অর্থপাচার হয়নি। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, অর্থপাচারের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। বড় বড় দেশগুলো তালিকায় কেন আছে জানেন? যার ইকোনমি যত বড়, তার ওখান থেকে ততবেশি অর্থপাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এসব দেশেও এস্টিমেট দেয়, পরিপূর্ণ তথ্য দেয় না। যে অর্থপাচারের কথা বলা হয়, তার যদি দশভাগের একভাগও বাংলাদেশে হতো, তাহলে বাংলাদেশে এই উন্নয়ন হতো না।

আমি বলছি না, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার হয় না। নেপাল থেকেও হয়। মালদ্বীপ থেকেও হয়। পৃথিবীর সব দেশ থেকেই হয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে অর্থপাচারটা হয়, সেটি একটা সহনীয় মাত্রারও মধ্যেই আছে। কিন্তু যে পরিমাণ বাড়িয়ে বলা হয়, সেটি ভুল। অর্থপাচারে বাংলাদেশ প্রথম ২০টি দেশের মধ্যেই নেই। সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় ইন্ডিয়া এবং চায়না থেকে। ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ কিন্তু চায়নার মতো একটি একদলীয় শাসনের দেশ, তারাও অর্থপাচার নিয়ে সংগ্রাম করছে। এটা এমন একটি রোগ, পৃথিবীর সবাই এটা নিয়ে যুদ্ধ করছে। আমাদের ক্ষেত্রে খবরগুলো এমনভাবে করা হয় বা এসব গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে বলে, যেন এটা বাংলাদেশের একটি ইউনিক সমস্যা। শুধু শেখ হাসিনাই এটাকে ম্যানেজ করতে পারছে না। দুনিয়ার আর সবাই ম্যানেজ করে ফেলছে। এই যে চালাকিগুলো তারা করে,এটা সমস্যা।

একবার একটি খবর এলো সুইসব্যাংকে ২০ শতাংশ ডিপোজিট বেড়েছে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা যখন শপথ নেন, তখন দেশের জিডিপির আকার ছিল ৯৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে দেশের জিডিপির আকার ৪৪৮ বিলিয়ন ডলার। আমার দেশের জিডিপি চারশ শতাংশ বাড়ল, তাহলে তো আনুপাতিক হারে অর্থপাচার বাড়ার কথা ৪০০ শতাংশ। সেখানে সুইসব্যাংকে ডিপোজিট বেড়েছে ২০ শতাংশ, তাহলে তো অর্থপাচার কমেছে। আর দশটা দেশের মতো বাংলাদেশেও অর্থপাচার হয়, তবে যেটা আছে সেটাও আটকানোর চেষ্টা করতে হবে।

কালবেলা: বর্তমানে আরও একটা সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে খেলাপি ঋণ। সরকার এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কেন?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: খেলাপি ঋণ আগে যা ছিল, তার চেয়ে বেড়েছে সত্য। কিন্তু যে পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়েছে, তার সাপেক্ষে কী খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে? তা কিন্তু না। আমরা তুলনা করছি, ১৫ বছর আগে এই পরিমাণ খেলাপি ঋণ ছিল, এখন এটা হয়েছে; তার মানে খেলাপি বেড়ে গেছে। সবকিছু যে বেড়েছে, তার প্রেক্ষিতে হিসাব করছি না। তারপরও আমি মনে করি,এ জায়গাতে আরও বেশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ একটি উঠতি ইকোনমির দেশ। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ বা শক্তি প্রয়োগ করা হয় তবে অর্থনীতির গতি কমে যাবে। তাই কিছুটা শিথিলতার দরকার আছে।

কালবেলা: ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি কিনতে পারছে না সরকার। লোডশেডিং বাড়ছে। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি। ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে অনেক অর্থ দিতে হচ্ছে সরকারকে। এগুলো কি ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা নয়?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: ডলারের সংকট গোটা বিশ্বেই চলছে। এটিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই আমানতের সুদের হার বাড়িয়েছে। কেন বাড়িয়েছে? যাতে সে ডলার নিজের কাছে আটকে রাখতে পারে। তারা এটি করছে নিজের অর্থনীতি ঠিক রাখার জন্য। যেখান থেকে ডলার উৎপাদন হয়, সে যদি আটকে রাখে তাহলে তো বৈশ্বিকভাবে ডলারের সংকট হতে বাধ্য। জ্বালানির সংকটও একই কারণে। এ ক্ষেত্রে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি জ্বালানির ক্ষেত্রে জ্বালানি বহুমুখীকরণের ব্যবস্থা না করলে, এখন তো দিনে ৮-৯ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হতো। প্রধানমন্ত্রী কয়লাভিত্তিক জ্বালানির ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। কয়লাভিত্তিক জ্বালানি নিয়ে এতদিন যারা বিরোধিতা করেছে, আজ তারা কোনো কথা বলছে না। কারণ আজ এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই আমাদের বাঁচাচ্ছে। যারা এতদিন বিরোধিতা করেছিল, তারা এসে এখন বলুক সরকার ভুল করেছে!

কালবেলা: অনেকেই বলে থাকেন এই সরকারের আমলে অসৎ ব্যবসায়ীরা আরও বেশি ক্ষমতায়িত হয়েছেন। তারাই দেশ চালাচ্ছেন। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: পৃথিবীতে সব জায়গাতেই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, প্রশাসন, সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিতভাবে দেশ পরিচালিত হয়। সবাইকে নিয়ে একটা সমাজ-আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে ওঠে। এটাকে অন্যভাবে দেখার তো কিছু নাই; দুনিয়াজুড়েই এটা আছে। প্রধানমন্ত্রী কোনো ব্যবসায়ীকেই বাড়তি সুযোগ দেননি। ব্যবসায়ীদের দিয়ে কাজ করিয়েছেন, তাতে সাধারণ জনগণ উপকৃত হয়েছে।

কালবেলা: অনেকেই ধারণা করছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এড়ানোর কোনো প্রচেষ্টা সরকারের আছে কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত: আমরা যখন অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলাপ করি তখন দুটো বড় ফ্যাক্টরকে বাদ দিয়ে আলাপ করি। এক হচ্ছে কোভিড মহামারি, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কোভিড পুরো দুনিয়ার সাপ্লাই চেইন বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপরে এলো যুদ্ধ। কেউ চিন্তাও করেনি এই একুশ শতকে এসে ইউরোপে যুদ্ধ হবে। এই দুইটার প্রভাব আমাদের এখানেও পড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশটাকে যে জায়গায় নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন, এই দুটো ঘটনা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গতিকে ব্যাহত করেছে অনেকখানি। তারপরও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। আমাদের সবকিছু যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। এই দেশটা আমাদের, আমরা যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেই; তাহলে যে বিপদটা ঘাড়ে নেমে আসবে তার ফল আমাদেরই ভোগ করতে হবে। পৃথিবীর কেউই আমাদের গণতন্ত্র, অর্থনীতি কোনো কিছুই ঠিক করে দিতে পারবে না। আমাদেরটা আমাদেরই করতে হবে, তার জন্য আমাদের ভালোটা আমাদেরই বুঝতে হবে। মানুষকে বোকা বানানোর জন্য অনেকেই অনেক কথা বলবে, কিন্তু আপনার সিদ্ধান্তেই কে সরকারে যাবে না যাবে সেটা নির্ভর করছে। এখানেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে ভোটারদের।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় জামায়াতের মানববন্ধন

দখল-দূষণে বিলীনের পথে চরঠিকা-চরপাগলা খাল

দুমড়েমুচড়ে গেল প্রাইভেটকার, সব যাত্রী নিহত

তেঁতুলিয়ায় মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা

পাটুরিয়া ও আরিচায় ফেরি চলাচল শুরু

টিভিতে আজকের খেলা (১০ ডিসেম্বর)

গাজায় যুদ্ধ গিয়ে পঙ্গু ২ হাজার ইসরায়েলি সেনা

ভিলার কাছে এবার ধরাশায়ী আর্সেনাল

কারাগারে বসেই আবারও অনশনে যাচ্ছেন নোবেলজয়ী নার্গিস মোহাম্মদি

বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকা

১০

গাজায় ছেলের পর ইসরায়েলি মন্ত্রীর ভাগনে নিহত

১১

ভারত থেকে এলো ৭৪৩ টন পেঁয়াজ

১২

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে নিয়োগ

১৩

পাটুরিয়া ও আরিচায় ফেরি চলাচল বন্ধ

১৪

আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস

১৫

১৬ লাখ টাকা বেতনে চাকরি, পাবেন চিকিৎসা ভাতাও

১৬

অনিদ্রা শনাক্ত করবে ই-ক্যাপসুল

১৭

ইন্টার্ন করার সুযোগ দিচ্ছে ওয়ালটন

১৮

এসএসসি পাসেই বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে চাকরি

১৯

প্লাস্টিক বর্জ্যের নতুন সমাধান

২০
X