দলীয়ভাবে বর্জন করলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা। কেউ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, কেউ অন্য দলের, কেউ আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। মনোনয়নপত্র জমার পরই এসব নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। অবশ্য ছেড়ে আসা দলের কঠোর অবস্থান এই প্রার্থীদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং ভোটের মাঠে জয়ী হতে মরিয়া হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। কারণ তাদের জন্য এই নির্বাচন মর্যাদা ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
বিএনপির সাবেক নেতাদের মধ্যে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির চেয়ারপারসন হয়েছেন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি সিলেট-৬ আসনে ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকে লড়ছেন। একই দলের মহাসচিব বিএনপির আরেক সাবেক নেতা তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর নতুন দল বিএনএমে যোগ দিয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হয়েছেন। তিনি ফরিদপুর-১ আসনে ‘নোঙ্গর’ প্রতীকে নির্বাচন করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে আছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ (কুমিল্লা-৫), চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ একরামুজ্জামান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১), মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান (কিশোরগঞ্জ-২), বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা মোহাম্মদ শোকরানা (বগুড়া-১), সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বিউটি বেগম (বগুড়া-২), সাবেক সংসদ সদস্য ডা. জিয়াউল হক মোল্লা (বগুড়া-৪) ও বগুড়া সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সরকার বাদল (বগুড়া-৭)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোটের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রার্থীরা মরিয়া হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। এই নির্বাচন মর্যাদার লড়াই হিসেবে নিয়েই বিজয় নিশ্চিত করতে সব রকম কৌশলই তারা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন।
সিলেট-৬ আসনে শমসের মবিন সম্ভাবনায়: বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী গত সেপ্টেম্বরে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবারের নির্বাচনে তিনি সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) আসনে ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকে লড়ছেন। শুরুর দিকে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও শেষ সময়ে এসে নানা হিসাব-নিকাশে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছেন। এখানে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মনোনীত নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং স্বতন্ত্র সরোয়ার হোসেন।
জানা গেছে, দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগ এখন তিন ভাগ হয়ে গেছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুর কাদির চৌধুরী এলিমের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ প্রকাশ্যে শমসের মবিনের পক্ষে কাজ করছে। গোলাপগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রুহেল আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে যে কাউকে ভোট দিতে উন্মুক্ত করা হয়েছে। সেই হিসেবে আমরা উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে পিছিয়ে পড়া গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজারকে এগিয়ে নিতে শমসের মবিন চৌধুরীর পক্ষে কাজ করছি।’
গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুর শাফি চৌধুরী এলিম বলেন, ‘বিগত দিনে এই এলাকায় তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। এলাকার মানুষ এবার উন্নয়নের স্বার্থে শমসের মবিন চৌধুরীকে বেছে নেবে।’
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘যেখানেই যাচ্ছি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। দলমত নির্বিশেষে মানুষ আমাকে ভোট দেবে।’
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৈমূর: বিএনপি ছেড়ে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব হন তৈমূর আলম খন্দকার। নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন তিনি। আসনটি ধরে রাখা যেমন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জের, তেমনই তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীর জন্য মর্যাদার।
তৈমূর আলম খন্দকার কালবেলাকে বলেন, ‘আমি সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা দিয়েছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ভোটারদের কাছে অনুরোধ, আপনারা ভোটকেন্দ্রে আসুন।’
ঝালকাঠি-১ আসন ফুরফুরে শাহজাহান ওমর:গত ৩০ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পান সেই সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকা শাহজাহান ওমর। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেও ভোটের মাঠে প্রথমদিকে খুব সুবিধা করতে পারেননি তিনি। পরে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমীর হোসেন আমুর উদ্যোগে স্থানীয় নেতাকর্মীরা শাহজাহান ওমরের পক্ষে সক্রিয় হন। বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন নিজ কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে নৌকার প্রতি সমর্থন জানান। অন্যদিকে ঝালকাঠি-১ আসনে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য মো. মনিরুজ্জামান মনিরও নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। ফলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এখন অনেকটা ফুরফুরে শাহজাহান ওমর।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ একরামুজ্জামান। তার পক্ষে প্রতিদিনই ব্যাপক প্রচারণা চলছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের বিভক্তির কারণে নির্বাচনী মাঠে সুবিধা পাচ্ছেন সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত তিন নেতা তার পক্ষে মাঠে কাজ করছেন। এ ছাড়াও জাতীয় পার্টির প্রার্থী মুহাম্মদ শাহানুল করিমও নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে একরামুজ্জামানকে সমর্থন দিয়েছেন।
সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘আগে দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছি। এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করায় আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা আছেন। আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে চাপে মেজর আখতার কিশোরগঞ্জ-২ আসনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। এই আসনে নৌকার প্রার্থী সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দ। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীকে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মো. সোহরাব উদ্দিন নির্বাচন করছেন।
জানা গেছে, আওয়ামী ঘরানার দুই প্রার্থীকে ঘিরে দলের নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। পদধারী নেতাদের একটি অংশ নৌকার পক্ষে, অন্য অংশ ঈগলের পক্ষে কাজ করছে। সাবেক এমপি সোহরাব উদ্দিনের তৃণমূলে অনেক সমর্থক আছে। আবার আব্দুল কাহার আকন্দ চাকরি ছেড়ে নতুন রাজনীতিতে নামলেও নৌকার প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী তার পক্ষে।
বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা আখতারুজ্জামান হেভিওয়েট প্রার্থী হলেও মাঠে তার অবস্থান দুর্বল। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হওয়ায় এবং তারেক রহমানের সমালোচনা করায় বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশে পাচ্ছেন না তিনি। অবশ্য বর্তমান এমপি নূর মোহাম্মদসহ মাঠ পর্যায়ের অনেকে তাকে সমর্থন করছেন বেলে জানা গেছে।
কুমিল্লা-৫ আসনে চ্যালেঞ্জে শওকত মাহমুদ: কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির বহিষ্কৃত ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ। ঈগল প্রতীক নিয়ে তিনি জোর প্রচারণা চালাচ্ছে। এলাকায় প্রচার আছে, সরকারের সবুজ সংকেত পেয়েই শওকত মাহমুদ প্রার্থী হয়েছেন।
শওকত মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস করলে ৬২টি মামলা কেন? ভালো ভোট হলে আমিই জিতব। তবে কালো টাকা ছড়ানো হচ্ছে বলে খবর পাচ্ছি। নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানাই।’
সুবিধাজনক অবস্থানে বগুড়ার চার জন:বগুড়ার চারটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছেন বিএনপির সাবেক চার নেতা। ভোটের লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত তারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বগুড়া-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির সাবেক নেতা মো. শোকরানা (কেটলি)। প্রচার-প্রচারণায় তিনি মাঠ গরম করে রেখেছেন। তার সভা-সমাবেশে পুলিশি পাহারা দেখা যাচ্ছে।
মোহাম্মদ শোকরানা বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি যে চাপ আছে তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু করা ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই।’
বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাবেক নেতা বিউটি বেগম। ট্রাক প্রতীক নিয়ে তিনি রীতিমতো সাড়া ফেলছেন। আট জন ইউপি চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত মেয়রসহ আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বিউটি বেগম বলেন, ‘জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।’
বগুড়া-৪ আসনে ছয় প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপির চারবারের এমপি জিয়াউল হক মোল্লার ঈগল ও জাসদের রেজাউল করিম তানসেনের নৌকা প্রতীকের মধ্যে।
ডা. জিয়াউল হক মোল্লা বলেন, ‘আমার বিশ্বাস নির্বাচনে কারচুপি কেউ করতে পারবে না। এখানে আমার বাবার পর আমিই বিএনপি সৃষ্টি করেছি। এটাই আমার বড় সাহস। জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’
খালেদা জিয়ার আসন হিসেবে পরিচিত বগুড়া-৭ (শাজাহানপুর-গাবতলী)। এখানে ঈগল প্রতীকে নির্বাচন করছেন বিএনপির সাবেক নেতা সরকার বাদল। তিনি বলেন, ‘এ আসন বিএনপির ঘাঁটি। সেই ঘাঁটিতে আমি নির্বাচন করছি এর মান-মর্যাদা রক্ষার করার জন্য।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সিলেটের মিঠু দাস জয়, বগুড়ার প্রদীপ মোহন্ত, ঝালকাঠির সামীর আল মাহমুদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রকাশ দাস, কিশোরগঞ্জের শরফ উদ্দিন জীবন, কুমিল্লার আতিকুর রহমান এবং রূপগঞ্জের জাহাঙ্গীর মাহমুদ।)