দেশের বিচারব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিমুক্ত করতে নজিরবিহীন এক উদ্যোগ নিয়েছে মেক্সিকো সরকার। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশটি এমন এক নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, যেখানে দেশের জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে বিচারপতি নির্বাচন করেছেন। বিচারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এই সিদ্ধান্ত ঘিরে বিতর্ক ও উদ্বেগও রয়েছে।
সংবাদমাধ্যম এএফপির খবরে বলা হয়, নজিরবিহীন এই নির্বাচন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে মাদকচক্রসহ বিভিন্ন অপরাধী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী। তবুও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশটির বিচারব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মেক্সিকো সরকারের দাবি অনুযায়ী, এই সংস্কারের মাধ্যমে মেক্সিকো এখন বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থেকে শুরু করে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত সবাই সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হচ্ছেন। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি কেবল একটি সাংবিধানিক পরিবর্তন নয়, বরং বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দায়মুক্তি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
ভোটের আগের দিন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাউম এক ভিডিও বার্তায় সমালোচনার জবাব দিয়ে বলেন, ‘যারা বিচার বিভাগের দুর্নীতিপূর্ণ ও বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত পুরোনো শাসন বজায় রাখতে চায়, তারাই এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কারচুপির অভিযোগ করছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো আদালতকে আবার রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনা।’
তিনি আরও বলেন, “এই সংস্কার গণতন্ত্রের পথে এক সাহসী পদক্ষেপ, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জনগণের ওপর আস্থা প্রতিষ্ঠা করবে।”
৫৭ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক আর্তুরো গিসেমান জানান, ‘আমি বিচার বিভাগের যে দুর্নীতি দেখেছি, তাতে আমার আস্থা নষ্ট হয়েছে। তাই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে আমি এবার ভোট দিয়েছি।’
তবে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই প্রথমবার আয়োজিত ভোটে জনগণের অংশগ্রহণ খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। দেশজুড়ে মাত্র ১৩ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
নতুন এই নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের মতে, বিচারপতি নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাধারণ ভোটারদের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন, কারণ এতে শত শত প্রার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ড, অভিজ্ঞতা ও নৈতিক চরিত্র মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে।
সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড শার্ক বলেন, ‘সাধারণ ভোটারদের পক্ষে শত শত প্রার্থীর তথ্য ঘেঁটে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। এতে বিচার ব্যবস্থা আরও বেশি রাজনৈতিক প্রভাবের মুখে পড়তে পারে।’
তার মতে, মেক্সিকোতে বিচার বিভাগের দুর্নীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কৌঁসুলিদের দপ্তর, যেখানে প্রকৃত সংস্কার প্রয়োজন।
এই নির্বাচনে অংশ নিতে যেসব প্রার্থী আগ্রহী ছিলেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত প্রযোজ্য ছিল। প্রার্থীদের অবশ্যই আইন বিষয়ে ডিগ্রি থাকতে হবে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা থাকতে পারবে না এবং ‘ভালো সুনাম’ থাকা আবশ্যক।
রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রায় ৮৮০ ফেডারেল বিচারক নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও রয়েছেন। একইসঙ্গে স্থানীয় স্তরের শত শত বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটও নির্বাচিত হন। অবশিষ্ট পদগুলোর জন্য পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৭ সালে।
মেক্সিকোর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে দেশজুড়ে যেমন আশাবাদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রশ্ন ও শঙ্কাও। একদিকে সরকার এটিকে গণতন্ত্রের অগ্রগতি হিসেবে তুলে ধরছে, অন্যদিকে বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন যে, এতে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অপরাধীদের হুমকির ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
তবুও এটুকু বলা যায়, মেক্সিকোর ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, যার ফলাফল ভবিষ্যতে দেশটির আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রকৃত চেহারা গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
মন্তব্য করুন