

ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর নজিরবিহীন চাপের মুখে পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা শুধু আদালতের কাজই কঠিন করে তোলেনি, আইসিসির বিচারক ও প্রসিকিউটরদের ব্যক্তিগত জীবনেও ডেকে এনেছে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা। গাজায় সংঘাত চলাকালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ওয়াশিংটন সরাসরি আদালতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক বিরল ও বিতর্কিত ঘটনা।
দৈনন্দিন জীবনে অদেখা চাপ: আইসিসির বিচারক ও প্রসিকিউটররা জানান, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড ও অনলাইনে আর্থিক সেবার মতো দৈনন্দিন জীবন-যাপন সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিষেবা হঠাৎই অকার্যকর হয়ে পড়ে। অনেকেই ডিজিটাল পরিষেবায় প্রবেশাধিকার হারান, এমনকি দৈনন্দিন ব্যবহৃত ই-বুক বা স্মার্টহোম সেবাও বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা থেকে, যেখানে নিয়মিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্স বা আলোচনায় অংশ নেওয়া তাদের কাজের অংশ ছিল।
একাধিক বিচারক জানান, নিষেধাজ্ঞা তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে সন্তানদের শিক্ষা ও ভ্রমণ পরিকল্পনায়। এক বিচারক বলেন, ‘আমাদের এমন এক তালিকায় ফেলা হয়েছে যেখানে সাধারণত অপরাধী বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের নাম থাকে। এটি আমাদের পেশাগত সম্মান ক্ষুন্ন করে।’
চাপের মধ্যেও অটল আইসিসি : যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন বাধা ও প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের প্রত্যয়ের কথা জানিয়েছেন আইসিসির বিচারক ও প্রসিকিউটররা। তারা বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা বিচারপ্রক্রিয়া থামাতে পারবে না। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অবিচল থেকে তারা তদন্ত ও শুনানির কাজ চালিয়ে যাবেন। চাপ যতই হোক, ন্যায়বিচারের দায় থেকে তারা পিছিয়ে যাবেন না।
গতকাল শুক্রবার বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার কারণে হেগের আদালতের নয়জন কর্মকর্তা যাদের মধ্যে ছয়জন বিচারক এবং প্রধান প্রসিকিউটরও রয়েছেন- ব্যক্তিগত আর্থিক লেনদেন, অনলাইনে কেনাকাটা, অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনা এমনকি ই-মেইল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের বাধার মুখে পড়ছেন। তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা সাধারণত সন্ত্রাসবাদ বা গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আরোপ করতে দেখা যায়।
কানাডীয় বিচারক কিম্বারলি প্রোস্ট বলেন, ‘আপনার পুরো পৃথিবীটাই যেন ছোট হয়ে আসে। এসব হয়তো ছোটখাটো বিষয়, কিন্তু প্রতিদিন জমতে জমতে তা বড় হয়ে ওঠে।’
নিষেধাজ্ঞায় পড়ার পর তার ক্রেডিট কার্ড অচল হয়ে পড়ে, কেনা ই-বুক গায়েব হয়ে যায়, আর আমাজনের ভার্চুয়াল সহকারী সেবা ‘অ্যালেক্সা’ সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ তদন্তে আদালতকে এগোতে দেওয়ার পক্ষে ভোট দেওয়ায় তাকে টার্গেট করা হয় বলে অভিযোগ কিম্বারলি প্রোস্টের। তিনি বলেন, ‘সারা জীবন ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করেছি, অথচ এখন আমাকে সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধে জড়িতদের তালিকায় রাখা হয়েছে।’
পরিবার-পরিজনও ভোগান্তিতে: নিষেধাজ্ঞা শুধু আইসিসির বিচারক ও প্রসিকিউটরদের নয়, তাদের পরিবারকেও প্রভাবিত করেছে। পেরুভিয়ান বিচারক লুজ ডেল কারমেন ইবানিয়েজ কারানজা জানান, তার মেয়েরা যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সম্মেলনে যোগ দিতে পারছেন না। ব্যাংক ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও ভয় পাচ্ছে। কারণ নিষেধাজ্ঞার আওত্তায় থাকা এসব মানুষের কাছে আর্থিক বা প্রযুক্তিগত সেবা দিলে বড় অঙ্কের জরিমানা বা কারাদণ্ডের ঝুঁকি রয়েছে।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে চাপ, হুমকির অভিযোগ: নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও আইসিসির ওপর রাজনৈতিক চাপও বাড়ছে। গত জুলাইয়ে মিডল ইস্ট আই জানায়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর প্রধান প্রসিকিউটর করিম খানকে ‘ধ্বংস করে দেওয়ার’ হুমকি দেওয়া হয়। হুমকিদাতা ছিলেন ব্রিটিশ-ইসরায়েলি আইনজীবী নিকোলাস কাউফম্যান, যিনি নেতানিয়াহুর পরামর্শদাতাদের একজনের সঙ্গে যুক্ত।
মন্তব্য করুন