ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিং তো দূরের কথা, কোনোদিন দলীয় কোনো প্রোগ্রামে অংশ নেননি সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে বিভিন্ন সময় দান-খয়রাতের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করলেও দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ছবি নেই তার। তবুও তিনি একই সময়ে ছাত্রলীগের তিনটি ইউনিটের পদধারী নেতা হয়েছেন। স্থানীয় এবং অন্যান্য ইউনিটের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানান, বড় বড় নেতাকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে এসব পদ পেয়েছেন সিয়াম। এ ছাড়া যেখানে যেতেন, সেখানেই অঢেল টাকা বিলাতেন তিনি। তার কাছ থেকে টাকা পেয়ে খুশি থাকতেন ওই নেতারাও। কিন্তু এই টাকার উৎস কী, কিংবা এত কম বয়সে লাখ লাখ টাকা কীভাবে খরচ করছিলেন সিয়াম—সে বিষয়ে কারও কোনো প্রশ্ন ছিল না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) অধীনে বিভিন্ন চাকরির প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় আলোচনায় আসেন প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম মূলহোতা পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী এবং তার ছেলে সিয়াম। প্রশ্নফাঁসে যুক্ত থেকে আবেদ আলী হয়েছেন বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক। কামিয়েছেন শতকোটি টাকা। বাবার এসব অবৈধ টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করতেন তার ছেলে। এরই মধ্যে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এই বাবা-ছেলেসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা এখন কারাগারে।
জানা যায়, সিয়াম একই সঙ্গে নিজ জেলা মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি, ভারত শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক। সম্প্রতি প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার পর তাকে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সিয়ামের নিজ এলাকা ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানান, হঠাৎ করেই নিজেকে উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ঘোষণা করে এলাকায় ব্যানার ফেস্টুন টানানো শুরু করেন সিয়াম। তার বাবা আবেদ আলীও হুট করে ডাসার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামেন। এর আগে কখনো এলাকাতেই যেতেন না এই বাবা-ছেলে। তবে সিয়াম এই পদ কীভাবে পেয়েছেন, সেটা সম্পর্কে জানেন না খোদ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। পরে এলাকার অন্য নেতাকর্মীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা ছাত্রলীগের নেতাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে এই পদ নিয়েছেন সিয়াম।
ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, সিয়াম কখনো দলীয় প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। সে এলাকায় এসে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াত এবং টাকা বিলাত। প্রায়ই ফেসবুকে দেখা যেত, গরিব মানুষকে টাকা দিয়ে সেসবের ভিডিও তৈরি করে এবং বড় বড় নেতার সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো পোস্ট করত। তার বাবার হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তাদের হুমকি-ধমকিও দিত সিয়াম।
ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ অনিক বলেন, সিয়াম ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি। তাকে ছাত্রলীগের কোনো প্রোগ্রামে কোনোদিন পাইনি। নামমাত্র পদে আছে। জেলা ছাত্রলীগের নেতাদের মাধ্যমে সে উপজেলা ছাত্রলীগের পদ পেয়েছে। আমরা কেউ তাকে নেতা বানাইনি।
এ বিষয়ে জানতে মাদারীপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদ হোসেন অনিককে ফোন করলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায় এবং সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ হাওলাদারকে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ভারতে সিয়াম পড়াশোনা করেছেন শিলিগুড়ির জি ডি গোয়েঙ্কা পাবলিক স্কুলে। সে সময় তিনি নিজেকে ভারত ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিতেন। জানা যায়, নিজ জেলার এক কেন্দ্রীয় নেতাকে টাকা এবং উপঢৌকন দিয়ে ম্যানেজ করে এই পদ বাগিয়ে নেন তিনি। বিভিন্ন সময় ওই নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবিও ফেসবুকে দিয়েছেন সিয়াম।
একই অভিযোগ আছে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগে পদ পাওয়া নিয়েও। এই ইউনিটের বিভিন্ন নেতা জানান, সভাপতি রিয়াজ মাহমুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং টাকার বিনিময়ে এই পদ নেন সিয়াম। বিভিন্ন সময় শুধু নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকেই দিয়েছেন তিনি, কখনো কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেননি। এ ছাড়া অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে দামি দামি উপহার দিতেন সিয়াম। টাকা এবং উপহার পেয়ে নেতারাও তাকে পাত্তা দিতেন।
টাকার বিনিময়ে সিয়ামকে পদ দেওয়া হয়েছে—এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ বলেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রমূলক কথা। আমার সঙ্গে তার তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর মাধ্যমে তাকে আমি চিনেছিলাম। এরপর ফেসবুকে দেখতাম সে অনেক মানুষের উপকার করত, ত্রাণ দিত। এজন্য তাকে ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক বানিয়েছিলাম। এর জন্য কোনো টাকার লেনদেন হয়নি।