এ জেড ভূঁইয়া আনাস
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৬ মে ২০২৫, ০৭:৪০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডলারের দর ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ

বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার
ডলারের দর ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী দেশের মুদ্রা বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলার দর ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কিছু সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এজন্য বাজারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারির প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি ফের যুদ্ধে গড়ায় তাহলে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে সিন্ডিকেট ও যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই ডলার দর কমতে শুরু করতে পারে।

রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকায় অবস্থিত মানি চেঞ্জারগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার খোলা বাজারে ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৫ টাকা ৭৫ পয়সা পর্যন্ত। গত মঙ্গলবার এই ডলারের দর ছিল ১২৪ থেকে ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। অর্থাৎ মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হওয়ায় খোলা বাজারে ডলারের দর বেড়েছে ১ থেকে দেড় টাকা পর্যন্ত। একই অবস্থা দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। গতকাল দেশের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ডলার ১২২ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ১২৩ টাকায় বিক্রি করেছে। অর্থাৎ বাজারভিত্তিক হওয়ায় ব্যাংকে ডলারের দর বেড়েছে ৭৫ পয়সা থেকে ১ টাকা।

জানতে চাইলে একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা জানান, ডলারের দর বাজারভিত্তিক হওয়ায় দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তবে এখনো বাজারে ওইরকমভাবে প্রভাব তৈরি হয়নি। আগামী সপ্তাহে ডলারের বাজারের বিস্তারিত পরিস্থিতি বোঝা যাবে। তবে বাজারভিত্তিক হওয়ায় ডলারের দর অল্প বেড়েছে, এটা স্বাভাবিক। বাজারে ডলার সংকট না থাকলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে আশাবাদী তারা।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শওকত আলী খান কালবেলাকে বলেন, ‘মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হওয়ায় ভালো হয়েছে। বাজার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। আমরা আজকেও ১২২ টাকা ৫০ পয়সায় বেচা-কেনা করেছি। সামনে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়লে ডলারের দর আরও কমে যেতে পারে। অর্থাৎ আপাতত ডলারের দর অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক যে সিন্ডিকেট বাজারে হস্তক্ষেপ করে, তারাও এখন সুবিধা করতে পারবে না। কারণ আমাদের এখানে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ আছে। যাদের যে পরিমাণ ডলার দরকার সেই পরিমাণই ক্রয়-বিক্রয় করলে বাজারে সংকট তৈরির কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা বাজারে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, যাতে কেউ অতিরিক্ত ডলার মজুত করতে না পারেন। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি ভালো সিদ্ধান্ত।’

মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব মো. হেলাল উদ্দিন সিকদার কালবেলাকে বলেন, ‘ডলারের দর ধরে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমটি, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ। দ্বিতীয়টি, দুবাইভিত্তিক সিন্ডিকেট। এখন যদি ভারত-পাকিস্তান নতুন করে যুদ্ধে না জড়ায় এবং দুবাইভিত্তিক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে। কিন্তু সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে যে কোনো মুহূর্তে বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাজার এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আজকে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা ৭৫ পয়সা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে ডলারের দর আরও কমে যেতে পারে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ডলারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, বেনামি ঋণ, তারল্য সংকট ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা সমস্যা থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় স্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, ২০২২ সালের শুরুতে ডলারের দামে যে অস্থিরতা শুরু হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা থেমে গেছে। অর্থ পাচার কমে আসায় বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়ছে। এতে রিজার্ভও বাড়ছে। এ ছাড়া আর্থিক হিসাবের ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে পৌঁছেছে, কমে এসেছে চলতি হিসাবের ঘাটতি।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাড়ে ১০ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় ২৫ বিলিয়ন বা আড়াই হাজার কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে দেশে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। সেবার প্রবাসীরা পাঠান ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য নিষ্পত্তি সংস্থা এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বকেয়া পরিশোধের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে। অন্যদিকে গ্রস রিজার্ভ রয়েছে ২৫ বিলিয়নের ওপরে।

এদিকে, আইএমএফের ঋণের কিস্তিসহ বিভিন্ন বিদেশি ঋণদাতা সংস্থা থেকে আগামী জুনের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই অর্থ এলে সামনে রিজার্ভ আরও বাড়বে।

এতকিছুর পরও ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে ‘অদৃশ্য হাতে’ বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে বলে বুধবার জানিয়েছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আগের মতোই মুদ্রা বাজারে থাকবে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী ডলার ক্রয় ও বিক্রয় করবে, যাতে মুদ্রাবাজারে কোনো ধরনের অস্থির পরিবেশ তৈরি না হয়। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে অদৃশ্য হাতে মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’

এদিকে বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে ‘সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে মাসিক বিশ্লেষণ’ (এমএমআই) শীর্ষক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিনিময় হার ‘বাজারভিত্তিক’ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নানাভাবে সহায়ক হবে। সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশের যে সদিচ্ছা আছে, সংস্কারের যে তাগিদ আমরা অনুভব করছি, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা যাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির বহিস্থ খাত যে ভালো আছে, তাও বোঝা যাবে।”

তিনি আরও বলেন, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পর টাকার বিনিময় হার কিছুটা ওঠানামা করলেও সেভাবে অবমূল্যায়ন হয়নি। অর্থাৎ অবমূল্যায়নের চাপ দেখা যায়নি। আরও দু-এক দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। তখন বোঝা যাবে, কী হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে, কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে টাকার বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে, তাহলে হস্তক্ষেপ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সেই হাতিয়ার আছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘বিনিময় হার আরও নমনীয় করে ঋণের কিস্তি এলে এটা দেশের জন্য ভালো। এর মাধ্যমে আমরা বড় ঝুঁকি কাটালাম। কারণ, আইএমএফের ঋণ ঝুলে গেলে অন্য সহযোগী সংস্থার ঋণও আটকে যেত। বিনিময় হার আরও নমনীয় করার এখনই স্বস্তিকর সময়। কারণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ঊর্ধ্বমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস, কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম ১২ শতাংশ কমার পূর্বাভাস মিলেছে। তাই এখনকার চেয়ে উত্তম সময় আর নাও মিলতে পারে।’

এর আগে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০০৩ সালের ৩১ মে। ওই দিন থেকে টাকাকে ‘ভাসমান মুদ্রা’ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ডলারের মূল্যমান নির্ধারণের দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। নতুন এই বিনিময় হার আসলে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক ছিল না, বরং ছিল নিয়ন্ত্রিত বা ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং’। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা অতি মূল্যায়ন করত। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৮৬ বার অবমূল্যায়ন ও ৬ বার অতি মূল্যায়ন করেছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাঙামাটিতে ভাঙা হচ্ছে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য

গোপালগঞ্জে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা শামচুল গ্রেপ্তার

ইউনিয়ন ব্যাংকে চাকরির সুযোগ

চাঁদপুরে চুরি হওয়া পুলিশের অস্ত্র-গুলি ঢাকায় উদ্ধার

দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি কাশ্মীরের সমাধান ছাড়া সম্ভব নয় : আসিম ইফতিখার

আমরা ৯০ হাজার জীবন হারিয়েছি, ক্ষতি ১৫০ বিলিয়ন ডলার : শেহবাজ

১৭ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

আমাদের মিডিয়া ভারতকে উপযুক্ত জবাব দিয়েছে : সেনাপ্রধান

মাগুরার সেই শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় আজ

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১০

বাংলাদেশের ম্যাচসহ টিভিতে আজকের খেলা

১১

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১২

১৭ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৩

বাঞ্ছারামপুরে আম পাড়া নিয়ে সংঘর্ষ, টেঁটাবিদ্ধসহ আহত ৮

১৪

চকরিয়ায় অটোরিকশা-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২

১৫

বিসিএস ট্যাক্সেস অ্যাসোসিয়েশন অবৈধ ও বিলুপ্ত ঘোষণা

১৬

স্বাস্থ্য পরামর্শ / ঘন ঘন খিঁচুনি মৃগী রোগের লক্ষণ

১৭

রাজধানীতে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, একই পরিবারের দগ্ধ ৫

১৮

উত্তেজনাপূর্ণ শেষ ২.৫০ মিনিট কী আলোচনা করেছেন পাইলট-এটিসি

১৯

‘সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা কমলে দেশ সংকটে পড়বে’ 

২০
X