কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ মে ২০২৫, ০৮:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইশরাকের মেয়রের চেয়ার কতদূর

আইনি জটিলতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে
সংবাদ সম্মেলনে ইশরাক হোসেন। ছবি : কালবেলা
সংবাদ সম্মেলনে ইশরাক হোসেন। ছবি : কালবেলা

আদালতের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের ২০ দিন পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে বিএনপি নেতা প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনের শপথ পড়ানো হয়নি। এ বিষয়ে আইনি জটিলতা খতিয়ে দেখছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এদিকে ইশরাককে শপথ পড়ানো ও দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে গতকাল শনিবার সচিবালয় অভিমুখে তার অনুসারীদের লংমার্চ কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি শেষে নগর ভবনে ৬৫টি তালা ঝুলিয়েছেন তার সমর্থকরা। এতে নগর ভবন থেকে সেবা-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ইশরাকের শপথে কালবিলম্ব করার জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে দায়ী করে তাকে নগর ভবনে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছেন বিক্ষোভকারীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনি জটিলতার কারণে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানো নিয়ে দোটানায় আছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিএনপি বলছে, এখন সরকারের উচিত দ্রুত তার শপথের ব্যবস্থা করা। ইশরাক হোসেন অভিযোগ করেছেন, শপথ পড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করছে সরকার।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক কালবেলাকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো ফল ঘোষণা করা। তারপর শপথ পড়ানোর দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের আর কোনো ভূমিকা নেই। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করেছে সরকার। এ জন্যই হয়তো স্থানীয় সরকার বিভাগ শপথ পড়ানো নিয়ে দোটানার মধ্যে আছে।

তিনি আরও বলেন, মেয়র হিসেবে শেখ তাপসের শপথের পর থেকে মেয়াদ পাঁচ বছর শেষ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ওই নির্বাচনে ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এটা নিয়ে নিঃসন্দেহে আইনি জটিলতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস কালবেলাকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ইশরাকই বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু কারচুপি করে তখন তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা করেছিলেন। সেখানে তিনি জয়লাভ করেছেন। এরপর আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) ইশরাককে ডিএসসিসির মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এখন সরকারের উচিত, দ্রুত তার শপথের ব্যবস্থা করা।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মাহবুবা আইরিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

গতকাল সকালেই নগর ভবনে ঢোকার সবকটি ফটক আর সিঁড়িতে তালা ঝোলানো হয়। বন্ধ করা হয় ভবনে ওঠানামার সবকটি লিফট। ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে না বসানোর প্রতিবাদে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে নগর ভবনের সামনে থেকে সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ শুরু হয়। লংমার্চের মিছিলটি শিক্ষাভবন মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। পরে মিছিলটি নগর ভবনে ফিরে এসে অবস্থান কর্মসূচি থেকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তার সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।

শাহবাগ এলাকার খলিল শাহীন নামে একজন বলেন, ইশরাকের শপথ নিয়ে সরকার টালবাহানা করছে, বিএনপির নেতারা যেন ভালো কোনো অবস্থানে যেতে না পারে।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থেকে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। ময়লা-আবর্জনা ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। মেয়র না থাকার কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে। গত মেয়র নির্বাচনে ইশরাক হোসেন বিপুল ভোটে বিজয়ী হলে এই জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল স্বৈরাচার সরকার।

বংশালের বাসিন্দা ফজলুল হক বলেন, ইশরাক জনগণের ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা তাকে দ্রুত মেয়র হিসেবে দেখতে চাই। তার বিষয়টি কতদিন এভাবে আটকে রাখবে? সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন, কেন তাকে এখনো শপথ গ্রহণ করানো হচ্ছে না?

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও সচিব নগর ভবনে অবাঞ্ছিত: গত ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগলে ভবনের ৯ তলায় অবস্থিত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২৯ ডিসেম্বর থেকে নগর ভবনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলছিল। তবে গত বুধবার থেকে মেয়র পদে ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানোর প্রতিবাদে আন্দোলন করছিলেন তার সমর্থকরা। গতকাল নগর ভবনের সামনে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সাবেক সিনিয়র সচিব মশিউর রহমান হুঁশিয়ারি দেন যে, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তার সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিহত করা হবে। নগর ভবনের বাইরে সব আঞ্চলিক দপ্তরেও এই আন্দোলনের প্রভাবে কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। এ ছাড়া নগর ভবনের ১২, ১৩ ও ১৪ তলায় অবস্থিত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিবের কার্যালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায় আন্দোলনে। মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই দুই দিন নগর ভবনে প্রবেশ করতে পারেননি।

ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রাসেল রহমান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার থেকেই নগর ভবনের কার্যক্রম মূলত বন্ধ।’

নাগরিক সেবা বিঘ্নিত: নগর ভবন অবরুদ্ধের ঘটনায় সিটি করপোরেশনের ১৭ ধরনের নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী, প্রকৌশল, রাজস্ব আর ভান্ডার দপ্তরসহ সব বিভাগীয় দপ্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অন্যান্য আঞ্চলিক ৮টি দপ্তর আর ৭৫টি ওয়ার্ড অফিস। এ ছাড়া নগর ভবনে থাকা অঞ্চল-১ আর অঞ্চল-৪ এর সব ধরনের সেবাই বন্ধ হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ইশরাকের আবেদন: মেয়র হিসেবে শপথ পাঠ করানোর জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ইশরাক হোসেন। গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, শপথ গ্রহণের দাবিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। শপথ গ্রহণে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা হচ্ছে। নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও গড়িমসি করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

তিনি বলেন, আইনের স্পষ্ট বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে মামলা করা হয়েছিল। তাপস প্রভাব খাটিয়ে এ মামলা থামানোর চেষ্টা করেন। তখন আদালত আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে সব আইনি পদক্ষেপ মেনে আমরা রায় পেয়েছি। কাজেই আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন, তারা আদালত অবমাননা করছেন।

তিনি বলেন, আইন উপদেষ্টা বলেছেন, তাদের মতামত না নিয়েই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও তার মতামতের জন্য ফাইল টেবিলে পড়েছিল। কিন্তু ১০ কার্যদিবসের মধ্যে নিয়ম মেনেই গেজেট প্রকাশ করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে এ বিএনপি নেতা বলেন, এ উপদেষ্টা পরিষদের অধীনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কি না, এ নিয়ে জনগণের প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের ভেতরেই আরেকটি দল হয়েছে, যারা নিজেদের জন্য কাজ করছে। এনসিপির পক্ষ থেকে বিচারক ও বিচারকার্য নিয়ে বিষোদ্গার করা হচ্ছে। এমনকি তাদের স্বার্থে প্রশাসকও নিয়োগ দিতে চাচ্ছে।

ইশরাক হোসনেকে মেয়র ঘোষণা করে ২৭ মার্চ রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ের কপি পেয়ে ২২ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চায় নির্বাচন কমিশন। এরপর ২৭ এপ্রিল ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির নতুন মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।

পরদিন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল দাবি করেন, মন্ত্রণালয়ের মতামত দেওয়ার আগেই ইসি ইশরাক হোসেনের নামে গেজেট প্রকাশ করেছে। এরপর ৫ মে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবে কি না বা অন্য কোনো আইনি পদক্ষেপ নেবে কি না—দ্রুত সময়ের মধ্যে অবগত করার অনুরোধ জানায় স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে না বলে ১৩ মে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে ইশরাক সমর্থকরা আন্দোলন শুরু করলে গত বৃহস্পতিবার ডিএসসিসির ২০২০ সালের মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনের করা মামলার রায় ও নির্বাচন কমিশনের আপিল না করার বিষয়ে কোনো আইনি জটিলতা আছে কি না, তা জানতে চেয়ে বৃহস্পতিবার আইন ও বিচার বিভাগে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ।

আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মাহবুবা আইরিনের পাঠানো চিঠিতে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ এর ধারা ৬ অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে কোনো আইনি জটিলতা আছে কি না, সে বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাছুরের ওজন কম, বিতরণ না করে ফেরত দিলেন ইউএনও

আজ মেতে উঠুন ‘চায়ের আড্ডায়’

যুক্তরাজ্য থেকে বড় ধাক্কা খেল ইসরায়েল

আসিফ-মাহফুজকে পদত্যাগের আহ্বান ইশরাকের

হান্নান মাসউদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

মোবাইলে কথা বলার সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু

ইশরাককে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের আদেশ আজ

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক ফোরামের নেতৃত্বে শাকিল-অনিক

‘টুকরো টুকরো হওয়ার শঙ্কায় সিরিয়া, গৃহযুদ্ধ আসন্ন’

সাদা পাথর লুটপাটে জড়িত ১৪ জনের কারাদণ্ড

১০

গাজায় পুষ্টিহীনতা ও ওষুধের তীব্র সংকট, মৃত তিন শতাধিক

১১

আজকের দিন কেমন কাটতে পারে, জেনে নিন রাশিফলে

১২

শেরপুরে বন্যহাতির আক্রমণে দুজনের মৃত্যু

১৩

দুপুরের মধ্যে ৫ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১৪

টিভিতে আজকের খেলা

১৫

২১ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

২১ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৭

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৮

কাজে আসছে না কোটি টাকার ‘লাইটনিং এরেস্টার’

১৯

দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা

২০
X