বিদ্যমান ‘ঘোলাটে’ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের ফল নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানালেও প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো আশ্বাস পায়নি দলটি। বিএনপি এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে প্রধান উপদেষ্টা তার আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এমনকি আগামী জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতেও নির্বাচন সম্ভব কি না, সে বিষয়েও সরকারপ্রধানের কাছ থেকে কোনো ইঙ্গিত পায়নি দলটি। এমন প্রেক্ষাপটে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো বার্তা না পেলেও বৈঠকে বিএনপির তরফ থেকে এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে, তারা ড. ইউনূসের পদত্যাগ চান না। তারা তার সম্মানজনক বিদায় চান। ড. ইউনূসের হাতেই দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটুক, তারা সেটাই চান।
জানা গেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার চলমান বৈঠক শেষে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ইস্যুতে সরকারের তরফ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটা দেখে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপি। এখন পর্যন্ত দলটির অবস্থান হচ্ছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবিতে সভা-সমাবেশ-সেমিনারের মতো দলীয় বিভিন্ন ফোরাম থেকে তারা সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে। এ জন্য আরও কিছুদিন বিশেষত কমপক্ষে আরও দুমাস তারা সরকারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবে। এই সময় পরে নির্বাচন নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা করা না হলে কিংবা নির্বাচন প্রলম্বিত করার কোনো লক্ষণ স্পষ্ট হলে তখন রাজপথের কর্মসূচির কথা ভাববে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা আগের মতোই বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, এই সময়ের থেকে নির্বাচন এক দিনও পেছাবে না। তবে আমরা এখনো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতেই রয়েছি। বলেছি, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। আমরা এও বলেছি, সময়মতো এর ঘোষণা না পেলে প্রয়োজনে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।
সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনের দিনক্ষণ স্পষ্ট না করা এবং নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্যের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ‘পদত্যাগ ভাবনা’ ঘিরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তার সঙ্গে গত শনিবার বৈঠক করে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। এ সময় জামায়াত ও এনসিপির প্রতিনিধিরাও পৃথক বৈঠক করেন। গতকাল রোববারও প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করেন।
গতকাল রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটভুক্ত ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে তিনি বলেন, এই সরকারের নেতৃত্বে জনগণ দেশের ইতিহাসে অবিলম্বে অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি জাতীয় নির্বাচন দেখতে চায়। দেশের জনগণ সরকারের করুণার পাত্র নয়। সরকার অবশ্যই জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য। এখানে সরকারের মান-অভিমান বা রাগ-বিরাগের কোনো সুযোগ নেই।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন স্বাক্ষরিত তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠি দেয় বিএনপি। সেখানে সংস্কার, বিচার, নির্বাচন, করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, ইশরাকের শপথ, সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নসহ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ লিখিত চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টাকে পড়ে শোনান।
চিঠিতে বলা হয়, জুলাই-ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাসম্ভব জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এই সর্বোচ্চ জনআকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। অথচ আগামীর বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি এই ঐক্যকে বজায় রেখে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এই ঐক্যের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখার কথা। কোনো মহলকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ না হয়, সেদিকে সচেতন থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে জনমনে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা, যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া দরকার।
মানবিক করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দর প্রসঙ্গে বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে যাতে দেশে অস্থিতিশীল কোনো পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত কেবল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার কর্তৃক জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হওয়াই সমীচীন।
চিঠির শেষদিকে বলা হয়েছে, আমরা যে বিষয়গুলো এই চিঠিতে উল্লেখ করেছি, সেগুলো আমাদের আগের প্রস্তাব ও পরামর্শের মতো উপেক্ষিত হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক এবং অনিবার্যভাবেই তা আমাদের সরকারকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে পরামর্শ দিতে নিরুৎসাহিত করবে।
বৈঠকে উপস্থিত বিএনপির দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপিকে কেন ডাকা হয়েছে, সে ব্যাপারে তারা অর্থপূর্ণ কিছু খুঁজে পাননি। একজন নেতা বলেন, বৈঠকের ফল শূন্য। বরাবরের মতো এবারও আমরা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টা শুনেছেন। তেমন কোনো মতামত দেননি।
বিএনপির একজন নেতা বলেন, বৈঠকে বিএনপি যেখানে স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছে, সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টাকেও রাখা হয়।
দলটির আরেক নেতা বলেন, তাদের প্রত্যাশা ছিল সরকার বিদ্যমান ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে দূরত্ব ঘুচিয়ে আনবে এবং নির্বাচন নিয়ে আশ্বস্তমূলক বার্তা দেবে। এর মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ নিয়ে রাজনীতিতে যে শঙ্কা রয়েছে, সেটাও কেটে যাবে।
বিএনপির সঙ্গে গত শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের আগে দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে দেওয়া উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যদি সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে—এমন কর্মকাণ্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উপদেষ্টা পরিষদের এই বিবৃতিকেও বিএনপি ভালোভাবে নেয়নি বলে নেতারা জানিয়েছেন।
মন্তব্য করুন