জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অনিশ্চয়তায় এবং প্রশাসনিক স্থবিরতায় যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যেই আজ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে নতুন এই বাজেট সংকোচনমূলক হবে বলে ধারণা দেওয়া হলেও তা আগের বাজেটগুলোর মতো গতানুগতিক ধারারই হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আজ বিকেল ৩টায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। সংসদ কার্যকর না থাকায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যমে বাজেট বক্তব্য একযোগে প্রচার করা হবে। নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সর্বশেষ সংসদের বাইরে বাজেট দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন ক্ষমতায় ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই বছরের ৯ জুন তখনকার অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ২০০৮-০৯ অর্থবছরের জন্য ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। সেদিনও ছিল সোমবার। বেলা ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচার করা হয়েছিল মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বাজেট বক্তৃতা। পরে আওয়ামী লীগের চার মেয়াদে সাড়ে ১৫ বছরে আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা ১০ বার, আ হ ম মুস্তফা কামাল পাঁচবার এবং আবুল হাসান মাহমুদ আলী একবার জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন। নির্বাচিত সরকারের আমলের এসব বাজেট জাতীয় সংসদেই উপস্থাপন করা হয়। পরে মাসজুড়ে সেই প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা হতো সংসদে। জুনের শেষ দিকে সংসদে পাস হতো নতুন অর্থবছরের বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে তা কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ৩০ জুন রাষ্ট্রপতি বাজেট অধ্যাদেশে সই করবেন। সেটাই হবে অফিসিয়াল বাজেট অনুমোদন। তবে বাজেটের অনেক অংশ, বিশেষ করে ট্যাক্স ও কাস্টমস-সংক্রান্ত বিষয়গুলো ২ জুন থেকেই কার্যকর হবে। অন্য বরাদ্দগুলো ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জিডিপি, মূল্যস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব আদায়, ব্যাংক ঋণসহ আসছে অর্থবছরের যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেগুলোর তুলনা চলছে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া তত্ত্ব-উপাত্ত্বের সঙ্গে। আগামী অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হবে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো দেশের জাতীয় বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় কমছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কম। প্রস্তাবিত ঘাটতি অর্থায়ন শতাংশের বিচারে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৬২ শতাংশের সমান। এই ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস তথা ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্রের ওপর ভরসার সঙ্গে বিদেশি ঋণের ওপরও নির্ভর করবে।
জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেশি। বিগত সরকারের মতো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও, সেখানে সরকার মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে; তবে কেবল সুদের হারের ওপর নির্ভরতা না রেখে অন্য কোনো উপায়ে এটি নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা থাকবে কি না, তা অর্থ উপদেষ্টার বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়েই বোঝা যাবে। নিম্ন আয়ের মানুষের আর্থিক চাপ কমাতে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণের ঘোষণা থাকতে পারে, যার আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ দুটিই বাড়ানো হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোর মধ্যে থাকছে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং প্রযুক্তি।
মন্তব্য করুন