প্রহসনমূলক, একতরফা এবং বিতর্কিত নির্বাচন করার কারণে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং কমিশনারগণ ও দোসরদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। মূলত ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনাকারী সিইসি এবং কমিশনারগণ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে দলটি। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ও বিএনপির মামলার সমন্বয়কারী সালাহউদ্দিন খান বাদী হয়ে আজ রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করবেন। তার নেতৃত্বে আজ সকালে একটি প্রতিনিধিদল ইসিতে এবং শেরেবাংলা নগর থানায় যাবে। প্রথমে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি নির্বাচন কমিশন অফিসে দেবেন তারা। এরপর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করবেন। যেহেতু নির্বাচন কমিশন তথা নির্বাচন ভবন শেরেবাংলা নগর থানায় অবস্থিত, সেজন্যই ওই থানায় মামলা করা হবে বলে জানান সালাহউদ্দিন খান। এরই মধ্যে ‘বিতর্কিত’ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িতদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘একতরফা বিনা ভোটের’ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের যাত্রা শুরু হয়। একই সঙ্গে পলাতক শেখ হাসিনাও বেপরোয়া হতে থাকেন। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও তিনি গায়ের জোরে ‘নিয়ম রক্ষার’ বিতর্কিত নির্বাচন করেছেন। এসব নির্বাচন দেশের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ওই তিনটি নির্বাচন পরিচালনায় সিইসির দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কেএম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনজনই তাদের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে ভালো হিসেবে দাবি করেছিলেন। বর্তমানে সাবেক তিন সিইসি ঢাকাতেই নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। অন্যান্য কমিশনার ও কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ দেশেই আছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, বিতর্কিত এবং একতরফা নির্বাচন না করতে বরং সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়েছিল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এমনকি ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের ওপর সারা দেশে বেপরোয়া হামলা এবং আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এসব হামলা বন্ধে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্য নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে জানিয়েছিল বিএনপি। তৎকালীন নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ তো নেয়নি, বরং বিএনপি নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা করেছিল পুলিশ।
এদিকে, গত সোমবার ‘বিতর্কিত’ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িতদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্যে রয়েছেন বিতর্কিত সাবেক তিন সিইসি, নির্বাচন কমিশনাররা ও কমিশন সচিবরা। গত সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ-সংক্রান্ত আলোচনা শেষে এ নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে এখন পর্যন্ত ওই তিন নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিএনপি নেতারা আলাপকালে জানান, ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনই ছিল ভোটারবিহীন, একতরফা, প্রহসনমূলক ও বিতর্কিত। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জয় এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন সিইসি, কমিশনার ও অধিকাংশ নির্বাচনী কর্মকর্তারা দায়ী। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার জন্য তারাই মূল কারিগর। তাদের সহায়তায় দেশে ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশের বিশাল একটি অংশকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। শেখ হাসিনা যেসব বেপরোয়া নির্বাচন করছেন, তার জন্য ওই তিনটি নির্বাচন কমিশনের সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি অংশ নিলেও ভোট গ্রহণের আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরা হয় বলে অভিযোগ ওঠে, যা রাতের ভোট নামে পরিচিতি পায়। ওই নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৮৮টি আসনে জয়ী হয়। অন্যদিকে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র ৮টি আসন। ভোটের মাঠে ঐক্যফ্রন্টের বহু প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। ওই সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন কে এম নূরুল হুদা ও নির্বাচন কমিশনার ছিলেন মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এবং মাহবুব তালুকদার (বর্তমানে প্রয়াত)।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা ‘আমি-ডামি ভোট’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ নির্বাচন আয়োজন করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন, যার কার্যক্রম নিয়ে শুরু থেকেই তীব্র বিতর্ক ছিল। ভোট গ্রহণ শেষে ভোটের হার নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দেয়। বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানানো হলেও এক ঘণ্টার ব্যবধানে তা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়। সিইসি প্রথমে ২৮ শতাংশ বললেও পরে তা সংশোধন করে ৪০ শতাংশ বলেন।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ও বিএনপির মামলা সমন্বয়কারী সালাহউদ্দিন খান গতকাল শনিবার কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন সব অনিয়ম ও কারচুপিকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক। এমনকি বিএনপিসহ বিরোধী দলের প্রার্থীদের ওপর অমানবিক হামলা-আক্রমণ করা হয়েছিল। দল থেকে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির দাবিতে লিখিতভাবে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছিল। দেশের বিরাট জনমতকে উপক্ষো করে গায়ের জোরে একতরফাভাবে নির্বাচন করেছিলেন শেখ হাসিনা। নানা কূটকৌশলে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে তিনবারই ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। পরপর প্রহসনের নির্বাচনে জয় পাওয়ার কারণে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন। তিনি ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন ওই তিন নির্বাচন কমিশনের সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার এবং তাদের দোসররা। মূলত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত এবং একতরফা ও বিনা ভোটের। সেজন্যই বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শেরেবাংলা নগর থানায় তৎকালীন সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। প্রথমে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেওয়া হবে। এরপর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করা হবে। মামলায় সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হবে বলে জানান সালাহউদ্দিন খান।
জানা গেছে, বিতর্কিত ওই তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনাকারী সাবেক তিন সিইসি ঢাকাতেই নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা দায়িত্ব ছাড়ার ৩ বছর পর্যন্ত বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুবিধা পান। এ ছাড়া তারা আমৃত্যু চিকিৎসা ব্যয় বাবদ খরচ পান। ৫ আগস্টের পর সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের কেউ ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের চাহিদা দেননি। চিকিৎসা খরচ নেওয়ারও প্রবণতা নেই।
মন্তব্য করুন