ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি ও যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের এমপি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে নিয়ম না মেনে রাজউকের প্লট এবং কোনো মূল্য পরিশোধ না করে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের ফ্ল্যাট নেওয়াসহ একাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলার তদন্ত ও সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে একাধিকবার টিউলিপকে তলব করেছে দুদক। তবে টিউলিপ যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও দুদক চিঠি পাঠাচ্ছে রাজধানীর পাঁচটি ঠিকানায়। এদিকে আবার টিউলিপ সিদ্দিকও তার আইনজীবীর মাধ্যমে তিন দফায় চিঠি দিয়ে দুদকের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন। যদিও দুদক আবার টিউলিপের কোনো চিঠির উত্তর দিচ্ছে না। এমনকি টিউলিপের পাঠানো মেইলেও দুদক কোনো জবাব দিচ্ছে না বলে অভিযোগ টিউলিপ সিদ্দিকের।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবার ও দলীয় লোকজনের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। এক পর্যায়ে দুদক টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার কথা জানায়। এরপর টিউলিপের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে রাজউকের প্লট গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়। এই ঘটনায় মামলার পর আদালতে অভিযোগপত্রও দাখিল করেছে দুদক। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ব্রিটিশ এমপি হিসেবে তার প্রভাব খাটিয়ে টিউলিপ তার খালাকে (শেখ হাসিনা) বোঝান যেন তিনি ঢাকার অভিজাত একটি আবাসিক এলাকায় তিনটি প্লট বরাদ্দ দেন তার মা শেখ রেহানা, ভাই রাদওয়ান ও ছোট বোন আজমিনার নামে। অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে টিউলিপের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। এ ছাড়াও সাভারে নিভৃত পল্লিতে ‘টিউলিট টেরিটরি’ নামে তার পরিবারের একাধিক বাগান বাড়ি, কোনো পারিতোষিক পরিশোধ না করে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের কাছ থেকে ফ্ল্যাট গ্রহণ, মাছের ঘেরের মাধ্যমে আয় দেখানো এমনকি এক বছরের ব্যবধানে ট্যাক্স ফাইলে বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ বৃদ্ধি পাওয়াসহ টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক। তবে টিউলিপ সিদ্দিক বরাবরই বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে এসব অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি এগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক বলে দাবি করেছেন।
দুদকের তলব, টিউলিপের উকিল নোটিশ: টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে একাধিকবার তলব করে রাজধানীর বিভিন্ন ঠিকানায় চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সর্বশেষ গত ১৫ জুন রাজধানীর পাঁচটি ঠিকানায় চিঠি টাঙিয়ে দেন দুদকের কর্মকর্তারা। চিঠিতে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিককে গত ২২ জুন সকাল ১০টায় দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছিল। চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্ধারিত সময়ে আপনি উপস্থিত না হলে এ বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য নেই মর্মে গণ্য হবে। তবে দুদকের ডাকে টিউলিপ কিংবা তার আইনজীবী কেউই দুদকে হাজির হননি।
অন্যদিকে গত ২৩ জুন আইনজীবীর মাধ্যমে দুদককে উকিল নোটিশ দিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান স্টেফেনসন হারউড এলএলপির মাধ্যমে এ নোটিশ পাঠিয়েছেন টিউলিপ। নোটিসে বলা হয়, ‘গত ১৮ মার্চ ও ১৫ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের চিঠি পাঠানো হয়। এরপর ৪ জুন একটি চিঠি পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। এখনো আমরা কিংবা টিউলিপ সিদ্দিক কোনো চিঠির জবাব পাইনি। আমরা চিঠিতে স্পষ্ট বলেছি, টিউলিপ সিদ্দিক একটি পরিকল্পিত প্রচারণার শিকার, যার নেপথ্যে রয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ও দুদক। আমাদের চিঠিপত্রে এটা দেখিয়েছি, কেন টিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটি অভিযোগ অসত্য।’ চিঠিতে দুদকের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ-চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়।
দুদককে চিঠির জবাব দিতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়, ‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন প্রধান উপদেষ্টা ও দুদকের এসব মিথ্যা প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। দয়া করে এখন এটি নিশ্চিত করুন যে, দুদকের তদন্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলছি, যদি এই চিঠি এবং আমাদের আগের চিঠিগুলোর যথাযথ জবাব ৩০ জুনের মধ্যে না দেওয়া হয়, তবে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তিসঙ্গতভাবেই বিষয়টির ইতি ঘটেছে বলে ধরে নেবেন।’
যা বলছে দুদক: গতকাল মঙ্গলবার দুদকের সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তিনি বলেন, ‘টিউলিপের সব অভিযোগ হাস্যকর। টিউলিপ সিদ্দিকের কেসটা কি এমন একটা কেস যেটা ব্রিটেনের ভঙ্গুর রাজনীতিকে আরও ভঙ্গুর করে তুলবে? আমরা যদি টিউলিপকে ব্রিটেনের নাগরিকও ধরি তাহলে, ব্রিটেনের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা হলেই সেই দেশের রাজনীতি ধসে পড়বে—এটা কি হতে পারে?’ টিউলিপের আইনজীবীকে ইঙ্গিত করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনজীবীরা যখন শব্দ চয়ন করেন তখন যেন তারা সঠিক শব্দ চয়ন করেন। তারা কিন্তু এভাবে তাদের নিজেদের দেশকে ছোট করছে।’
টিউলিপের অভিযোগের বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, টিউলিপ সিদ্দিকের ক্ষেত্রে আমরা বারবার বলেছি—এটা কোনো রাজনৈতিক মামলা নয়, এটা কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা নয়, এটা কাউকে ছোট করার জন্য কোনো মামলা নয়। আমাদের অনেক অভিযুক্ত আছে, টিউলিপ সিদ্দিকও আমাদের একজন অভিযুক্ত। দুদকে কখনো রাজনৈতিক মামলা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুদক কাজ করে পেপারবেইসড—ডকুমেন্টস থাকে, কাগজপত্র থাকে। সেই কাগজপত্রে যদি গরমিল থাকে, তবেই মামলা হয়। এর আগে মামলা হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এটা অ্যাবসুলেট ডকুমেন্টসবেইসড মামলা।’
দুদক টিউলিপ সিদ্দিকের কোনো চিঠির উত্তর দিয়েছে কি না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিককে আমরা প্রথমবারেই জানিয়ে দিয়েছি। পরে আদালতের প্রক্রিয়াটা হচ্ছে এরকম—আপনার নিজে এসে মোকাবিলা করতে হবে। আপনি নিজে আসতে পারেন, আপনার আইনজীবী আসতে পারে। কাজেই তিনি এটা অবহিত। তার চিঠিপত্রগুলোও আপনি লক্ষ্য করেন, তাতে স্পষ্ট হবে—যাই ঘটছে তিনি সবই জানেন।’
টিউলিপ সিদ্দিকের লন্ডনের ঠিকানায় কোনো চিঠি দেওয়া হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘তিনি (টিউলিপ) যে যে ঠিকানায় অবস্থান করে অপরাধ করেছেন, আমরা সেই সেই ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছি।’
মন্তব্য করুন