জমি বা অবকাঠামোর দাম বিবেচনায় রাজধানীর অন্যতম ব্যয়বহুল এলাকাগুলোর একটি মতিঝিল। ঢাকার প্রধান এ বাণিজ্যিক এলাকার কেন্দ্রস্থল সংলগ্ন সরকারি জমির ওপর ২ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি কর্মচারীদের জন্য আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। ‘মতিঝিল আইডিয়াল জোনে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পে ২০ দশমিক ৮১ একর জমিতে নির্মিত হবে ২৫ তলার ২০টি ভবন, একটি আটতলা মাল্টিপারপাস ভবন এবং একটি দুতলা সাবস্টেশন ও জেনারেটর ভবন। তবে বিশাল আয়তনের এ জমিতে আবাসনের সুযোগ পাবেন মাত্র ১ হাজার ৮৪০ জন সরকারি কর্মচারী।
নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞদের মতে, মতিঝিলের মতো এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির বাজারদর বর্তমানে আড়াই থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত। এ হিসাবে ২১ একর জমির দাম দাঁড়ায় ৫ হাজার ২৫০ কোটি থেকে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। সেই জমিতেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেখানে মাথাপিছু প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বরাদ্দ হচ্ছে একটি আবাসন ইউনিট। অবশ্য জমির দাম হিসাবে ধরলে মাথাপিছু এ ব্যয়ের পরিমাণ হবে কয়েকগুণ বেশি। তারা বলছেন, মতিঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও দামি এ সরকারি জমিতে আবাসন নয়, অন্য নানা কাজে ব্যবহার করা যেত, যা থেকে আয় করা সম্ভব বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। এরপরও যদি আবাসন প্রকল্প করতে হয়, তবে দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সেখানে অন্তত ১০০ বহুতল ভবন করা যেত। যেখানে বসবাস করতে পারত অন্তত ১০ হাজার সরকারি কর্মচারীর পরিবার। কিন্তু ৬ হাজার কোটি টাকার জমিতে প্রস্তাবিত এ আবাসনে মাত্র ১৮শ কর্মচারীর জন্য খরচ করা হবে ২৮শ কোটি টাকারও বেশি, যা স্পষ্টতই বিলাসিতা। দেশ-বিদেশে ফাইভ স্টার (পাঁচ তারকা) মানের হোটেল নির্মাণেও এত টাকা খরচ করা হয় না। এ জমিতে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেটসহ পূর্ণাঙ্গ একটি আবাসিক এলাকা করা যেত। কিন্তু তা না করে শুধু কিছু ভবন উঠিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর এতে বিপুল অর্থ ব্যয় এবং জমির অপচয় ছাড়া তেমন কোনো সুফল মেলে না।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, ৮৫০ বর্গফুট আয়তনের ৯২০টি এবং ১ হাজার বর্গফুটের আরও ৯২০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে দুটি ভিন্ন ধরনের প্রতিটি ২৫ তলা ভবনে। প্রতিটি ভবনে থাকবে চারটি করে ইউনিট। এ ছাড়া মাল্টিপারপাস ভবনে থাকবে লাইব্রেরি, জিমনেশিয়াম, মাল্টিপারপাস হল, ফার্মেসি ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আর সাবস্টেশন ও জেনারেটর স্থাপন করা হবে ৩০০০ বর্গফুট আয়তনের একটি আলাদা ভবনে।
এ প্রকল্পে শুধু আবাসন নয়, আধুনিক জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে। তৈরি করা হবে একটি সুসজ্জিত পুকুর ঘাট, দুটি ফুটবল-ক্রিকেট কম্বাইন্ড মাঠ, দুটি শিশুদের খেলার মাঠ, একটি জগিং ট্রেইল, অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ওয়াকওয়ে, আরসিসি মাস্টার ড্রেন এবং মনোরম পরিবেশ নিশ্চিতে ল্যান্ডস্কেপিং ও বৃক্ষরোপণ। পুরো প্রকল্পে ১৩৪৮ মিটার বাউন্ডারি ওয়াল (সীমানা প্রাচীর) ও গেট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যার প্রতি মিটার নির্মাণ খরচ প্রায় ৬১ হাজার ২০১ টাকা।
সার্বিক নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে ভবন নির্মাণেই ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। এর বাইরে বহিঃস্থ স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহে ৪৩ কোটি টাকা, বহিঃস্থ বিদ্যুতায়নে ২৮০ কোটি ৬৬ লাখ, আনুষঙ্গিক কাজে ১৭৫ কোটি ২৪ লাখ, ভূমি উন্নয়নে ৩ কোটি ৮২ লাখ এবং ফিজিক্যাল ও প্রাইস কনটিনজেন্সি বাবদ (আকস্মিক পরিস্থিতি বা অপ্রত্যাশিত খরচ মোকাবিলায়) আরও ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বৈদ্যুতিকসহ প্রকল্পের বিভিন্ন সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন, ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ইমার্জেন্সি জেনারেটর, ৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকায় ৮২টি লিফট (৪১টি ফায়ার লিফট, ৪০টি বেড লিফট এবং একটি প্যাসেঞ্জার লিফট), ১৫ কোটি ১৪ লাখ টাকায় সিসিটিভি (যার নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লিখিত নয়), ১২ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ফোর্সড ভেন্টিলেশন ও প্রেসারাইজড সিস্টেম, ৩৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় ফায়ার প্রটেকশন ও ডিটেকশন সিস্টেম এবং ২ কোটি ৮১ লাখ টাকায় পিএবিএক্স ও ইন্টারকম সিস্টেম।
আবাসিক ভবনগুলোর নান্দনিকতা এবং পরিবেশবান্ধব কি না, সেদিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ভবনে মার্বেল পাথরের সিঁড়ি ও লবির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া অ্যালুমিনিয়াম লুভার ও ডেকোরেটিভ ওয়ার্কসে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।
পানি সংরক্ষণ, সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫০ মিমি আকারের চারটি ডিপ টিউবওয়েল, ১০ কোটি ৯ লাখ টাকায় অগ্নিনির্বাপক ভূগর্ভস্থ জলাধার, ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকায় ২১টি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ইউনিট, ৮ কোটি টাকায় দুটি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় ওয়াটার পাম্প ও লাইন, ২ কোটি ৭১ লাখ টাকায় ৮২টি সেফটি ট্যাঙ্ক, ১ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ৮২টি সোকওয়েল এবং ২ কোটি ২৪ লাখ টাকায় ড্রেনেজ ও ঢাকনাসংক্রান্ত নির্মাণকাজ।
অন্যদিকে, আরসিসি ডাস্টবিন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ টাকা করে ১০টি ডাস্টবিনের জন্য। একটি মাত্র পুকুরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা, যার আয়তন ৪২৫৬ বর্গমিটার। একই সঙ্গে ৪৬৪ বর্গমিটারের একটি ঘাট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। জগিং ট্রেইল ও ওপেন ফিল্ডের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ টাকা, একটি চিলড্রেন প্লে জোনের জন্য বরাদ্দ ২ কোটি এবং একটি কম্বাইন্ড ফিল্ড নির্মাণে ব্যয় ৫ কোটি টাকা। সেফটি ক্যানোপি এবং সেফটি নেট বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৯ কোটি ২৫ লাখ।
প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় সাতজন কর্মকর্তার বেতন ও ভাতায় বরাদ্দ ৫ কোটি ৭ লাখ টাকা। তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তায় নিয়োজিত ছয়জন আইটি আউটসোর্স কর্মীর জন্য বরাদ্দ ৫৭ লাখ টাকা। অফিস কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ লাখ টাকার আসবাব, ৭০ লাখ টাকার গাড়ি ভাড়া, ২৫ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন ব্যয় এবং অন্যান্য স্টেশনারি, সিল, সম্মানী ও আপ্যায়ন বাবদ কয়েক লাখ টাকার বরাদ্দ।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫১৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৪ কোটি ২০ লাখ, ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৬২১ কোটি ২৫ লাখ এবং ২০২৮-২৯ অর্থবছরে ৬০৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় মোট ৫৪টি আবাসিক ভবন রয়েছে, যেগুলোর ৪৫টি নির্মিত হয়েছে ১৯৫৫ সালে এবং বাকি ৯টি হয়েছে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সময়ে। পুরোনো এ ভবনগুলো ভেঙেই নতুন বহুতল আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তর বলছে, ঢাকায় বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন, অথচ সরকার তাদের জন্য মাত্র ১৪ হাজার ৮০০টি ফ্ল্যাট সরবরাহ করতে পেরেছে, যা চাহিদার মাত্র ৯ শতাংশ। এ সংকট সমাধানে ৯ শতাংশ আবাসন সুবিধা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
এ প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘মতিঝিল প্রকল্পটি এখনো প্রস্তাবিত। ব্যয় নির্ধারণে অতিরিক্ত কিছু ধরা হয়নি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী রেড শিডিউল মেনেই সবকিছু করা হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ফাহমিদা বারী বলেন, ‘এ মুহূর্তে যে পরিমাণ অর্থ প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদনের সময় তা হ্রাস পেতে পারে। এখানে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়নি।।’
তবে নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আন্তর্জাতিক মানের কথা উল্লেখ করে বিপুল ব্যয় করলেই হবে না, একটি আবাসনে সে অনুযায়ী সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, ‘প্রায় ২১ একর জমিতে যদি ২৫ তলার ২০টি ভবন তৈরি করা হয়, তাহলে আগে দেখতে হবে সেই প্রকল্পে নিয়ম অনুযায়ী সবকিছু রাখা হয়েছে কি না। ২১ একর জমিতে ২০টি ভবনে ১ হাজার ৮৪০টি পরিবারের প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার লোক বসবাস করবে। এমন আবাসিক প্রকল্পে বাচ্চাদের জন্য একাধিক খেলার মাঠ, স্কুল ও কলেজ, পার্ক, ওয়ার্কওয়ে, স্বাস্থ্যসেবা, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা এবং মার্কেট থাকতে হবে। যদি না থাকে, তাহলে সেটা আবাসিক প্রকল্প হয় না, শুধু থাকার জন্য জাস্ট ভবনের ব্যবস্থা। কারণ এসবের ব্যবস্থা না রাখলে আশপাশের এলাকায় চাপ পড়বে।’
বিপুল ব্যয়ের বিষয়ে এ নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘শুধু আন্তর্জাতিক মানের কথা বলে ব্যয় ধরলেই হবে না। সরকারি নীতিমালা ও শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় ধরলেই হবে না, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। যদি না রাখা হয়, তাহলে আমি বলব পেশাদারিত্ব বজায় রেখে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়নি।’
মন্তব্য করুন