গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার শুরু ‘হানিট্র্যাপ’-এর (চক্রের নারী সদস্যের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে প্রতারণা) একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলে জানিয়েছে পুলিশ। হানিট্র্যাপের ওই ঘটনার ভুক্তভোগীকে কোপানোর ভিডিও ধারণ করায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাংবাদিক তুহিনকে। গতকাল শনিবার নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন তথ্য জানান গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম। তিনি বলেন, ধারণ করা ভিডিও ডিলিট না করায় (না মোছায়) তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
পুলিশ কমিশনার জানান, ঘটনার শুরু হয় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাদশা নামে এক ব্যক্তি একটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলার পর। সে সময় পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী নামে এক নারী তাকে ‘হানিট্র্যাপ’-এ ফেলার চেষ্টা করে। বিষয়টি টের পেয়ে বাদশা গোলাপীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে সরে আসার চেষ্টা করেন। গোলাপীর বিরক্তিতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাদশা তাকে ঘুসি মারলে পাশেই থাকা ওই নারীর সহযোগী প্রতারণা ও ছিনতাই চক্রের সদস্যরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাদশাকে কোপাতে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে বাদশা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীরা তাকে ধাওয়া দেয়। এই পুরো ঘটনার ভিডিও নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করছিলেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। ভিডিও ধারণের বিষয়টি দুর্বৃত্তরা দেখে ফেললে, তারা তুহিনকে ভিডিও ডিলিট করতে বলে। কিন্তু তুহিন রাজি না হওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। পরে তুহিন একটি মুদি দোকানে আশ্রয় নিলে সেখানেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার পরপরই একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে দেখা যায়, ঈদগাহ মার্কেটের নিচতলায় একটি কাপড়ের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পেছন থেকে একজন নারীকে ধাক্কা দেয় এক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে পেছন থেকে অস্ত্র নিয়ে ওই ব্যক্তির ওপর হামলা চালায় কয়েক যুবক। হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে পালায় ওই ব্যক্তি। এরপর ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে কাউকে খুঁজতে দেখা যায় ওই অস্ত্রধারী যুবকদের। কিছুক্ষণ পর তারাও ক্যামেরার বাইরে চলে যায়। ভিড় করে উৎসুক জনতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাশেই দাঁড়িয়ে এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। ভিডিও করতে দেখে তার ওপর হামলা চালায় ওই অস্ত্রধারী যুবকরা। এসময় তাদের হাত থেকে বাঁচতে মার্কেটের নিচের একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, চায়ের দোকানে গিয়ে তুহিনের ওপর হামলা চালানো হয়। শুরুতে মারধর করে ভিডিও ডিলিট করতে বললেও পরে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে হামলাকারীরা।
সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিও যাচাই করেছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্ত শেষে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এই পুরো ঘটনা নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিলেন সাংবাদিক তুহিন। ভিডিও করতে দেখেই সশস্ত্র হামলাকারীরা তার ওপর চড়াও হয়।
জিএমপি কমিশনার নাজমুল করিম বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে হানিট্র্যাপ ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিও ডিলিট না করায় সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিক তুহিনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত মোট আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে।’
ওই আটজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে জিএমপি এবং একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যা-১। এ ছাড়াও কিশোরগঞ্জ থেকে আরেকজনকে আটক করেছেন র্যাব সদস্যরা।
গ্রেপ্তারকৃতদের সবাই একাধিক মামলার আসামি বলে জানান জিএমপি কমিশনার। তাদের মধ্যে কেটু মিজান নামে একজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চিহ্নিত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় শুক্রবার মধ্যরাতে। এরা হলো- পাবনার চাটমোহরের পাঁচবারিয়া এলাকার ফয়সাল হাসান, কুমিল্লার হোমনার কাশিপুর এলাকার শাহ জালাল। এছাড়া সুমন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরও আটক করা হয় মো. মিজান ওরফে কেটু মিজান, তার স্ত্রী গোলাপী, আল-আমিন এবং মো. স্বাধীনকে। তারা সবাই ছিনতাইকারী দলের সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গতকাল সকালে র্যাব--১- এর পোড়াবাড়ি ক্যাম্প কমান্ডার সংবাদ সম্মেলনে জানান, স্বাধীন প্রাথমিকভাবে তুহিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তাকে মহানগরীর শিববাড়ী এলাকা থেকে আটক করা হয়।
জিএমপি কমিশনার বলেন, ‘গ্রেপ্তার আসামিরা যদি অপরাধ নাও স্বীকার তাহলেও তাদের এভিডেন্সই (প্রমাণ) তাদের অপরাধ প্রমাণ করবে।’ যথার্থ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারার দায় নিয়ে সাংবাদিক সমাজের কাছে দুঃখ প্রকাশও করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। এ ছাড়াও নিহত তুহিনের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তুহিন হত্যাকাণ্ডে পুলিশের কিছুটা ব্যার্থতারয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গ্রেপ্তাররা দুই দিনের রিমান্ডে : তুহিন হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার সাতজনের প্রত্যেককে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল বিকেলে গাজীপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. আলমগীর আল মামুন এ আদেশ দেন। এর আগে কড়া নিরাপত্তায় তাদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন এবং পুলিশি হেফাজতে নিতে নির্দেশ দেন।
তুহিন হত্যার আসামি শহীদুলকিশোরগঞ্জে গ্রেপ্তার : গতকাল বিকেলে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলা সদরের পুরাতন বাজার থেকে সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলার আসামি শহীদুল ইসলামকে (২৮) গ্রেপ্তার করে র্যাব-১৪- এর একটি দল। র্যাব-১৪- এর সিপিসি-২ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের অধিনায়ক মো. আশরাফুল কবির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গ্রেপ্তার শহীদুল ময়মনসিংহের ত্রিশালের বালিপাড়া এলাকার মৃত আব্দুল করিমের ছেলে। সে গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকার কবিরের বাড়ির ভাড়াটিয়া।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি।
মন্তব্য করুন