আতাউর রহমান
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:৩২ এএম
আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

টোলের নামে দিনরাত চাঁদাবাজি

ঢাকা দক্ষিণ সিটি
রাজধানীর শনির আখড়া ও ধোলাইখালে (ডানে) গাড়ি আটকে লাঠিয়াল বাহিনীর চাঁদা আদায়। ছবি: রনি বাউল
রাজধানীর শনির আখড়া ও ধোলাইখালে (ডানে) গাড়ি আটকে লাঠিয়াল বাহিনীর চাঁদা আদায়। ছবি: রনি বাউল

সুমন তালুকদার সাভারে তৈরি পোশাকের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ঢাকার বঙ্গবাজারসহ বিভিন্ন মার্কেট থেকে কাপড় কিনে নিজের দোকানে বিক্রি করেন। গত ৩১ আগস্ট দুপুরে গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার থেকে কিছু কাপড় কিনে তা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে। সেখানেই তাকে ঘিরে ধরে লাঠিয়াল দুই তরুণ। ১০০ টাকার রসিদ ধরিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে টোল দাবি করে তারা। বাধ্য হয়েই তিনি তা দিয়ে সাভারগামী বাসে ওঠেন। ওই যুবকদের নাম-পরিচয় জানতে চাইলেও তারা বলেনি। সিটি করপোরেশনের টোল আদায়কারী পরিচয় দিয়ে ফের ওই এলাকায় ঘিরে ধরে পণ্যবাহী একটি ভ্যানগাড়িকে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের একই কাজ করতে দেখা গেল।

কামাল হোসেন রাজধানীর উত্তরায় ‘ইভা ইলেকট্রনিকস’ নামের দোকানের মালিক। কাপ্তান বাজারের ইলেকট্রনিকস মার্কেট থেকে পাইকারি পণ্য কিনে নিজের দোকানে খুচরা বিক্রি করেন। গত সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ফুলবাড়িয়া মোড়ে ইলেকট্রনিকস পণ্যের কয়েকটি কার্টন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ওই খুচরা ব্যবসায়ী কালবেলাকে জানান, নিজের মাল নিজেই বহন করে এনেছেন। এর পরও কুলি খরচ হিসেবে তার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়েছে সিটি করপোরেশনের টোলের লোকজন।

এই চিত্র শুধু গুলিস্তানের নয়, পাইকারি বিপণিবিতান ও মার্কেটনির্ভর ঢাকা দক্ষিণের গোটা এলাকার চিত্র। খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে যাওয়ার সময়ে তাদের ওপর নিষ্ঠুর দৃষ্টি পড়ে টোল আদায়কারী লাঠিয়াল বাহিনীর।

দিনের চিত্র এমন হলেও রাতের সড়কে নেমে আসে আরও ভয়ংকর চিত্র। সড়কে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে চাঁদা নেয় লাঠিয়াল টোলবাজরা। চাঁদা না দিলে লাঠি দিয়ে ভাঙা হয় গাড়ির গ্লাস, পেটানো হয় চালকদের, হুমকি দেওয়া হয় পুরো গাড়ি গায়েবের। শুধু পণ্যবাহী ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানই নয়, এই টোলবাজদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সাধারণ যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস থেকে শুরু করে প্রাইভেটকারও। দেশের দক্ষিণাঞ্চলগামী প্রবাসীদের বহন করা ভাড়া প্রাইভেটকার তাদের বড় টার্গেট। এ ধরনের গাড়ি দেখলেই তারা লেজার লাইটের আলো নিক্ষেপ করে তা থামিয়ে টোলের নামে চাঁদা নেয়। ১৫ দিন ধরে দিনে-রাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে এমন ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিয়ম অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে ইজারাদার নিয়োগ দিয়েছে। কোথা থেকে ইজারাদাররা টোল আদায় করতে পারবেন, কুলির খরচ কত—তাও ইজারাদারদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। নিজের পণ্য নিজে বহন করলে কুলি খরচ দিতে হবে না, পণ্যবাহী চলন্ত কোনো ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান থামিয়ে টোল নেওয়া যাবে না—তা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে এতে। চলন্ত মাইক্রোবাস বা প্রাইভেটকার থেকেও যে টাকা নেওয়া যাবে না, তাও বলা আছে। কিন্তু এর কিছুই মানছে না ইজারাদারদের নিয়োগ করা টোলবাজরা। পুলিশের সঙ্গে সখ্য করে রাজনৈতিক নেতাদের মদদে এই অত্যাচার চলছে দিনের পর দিন।

সরেজমিন রাতের ঢাকা: ২৪ আগস্ট, রাত তখন সাড়ে ১১টা। পুরান ঢাকার বংশালের সুরিটোলা ওভারব্রিজের অদূরে লাঠি হাতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। পণ্যবাহী চলন্ত ট্রাক আর কাভার্ডভ্যান দেখলেই লেজার লাইটের রঙিন আলো নিক্ষেপ করছেন তারা, আবার কখনো লাঠি দিয়ে তা থামাচ্ছিলেন। ছোট্ট একটি স্লিপ ধরিয়ে নিচ্ছিলেন টাকা। ৫ থেকে ৬ জন, সবার হাতে লাঠি।

টাকা নেওয়া লোকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কেউ রাজি হলো না। তবে তাদের একজন চিৎকার করেই বলছিল, তারা সিটি করপোরেশনের লোক, টোল তুলছে। পরে একজনের নাম জানা যায় ইসমাইল হোসেন। তার দাবি, তারা ইজারাদারের হয়ে বৈধভাবে টোল আদায় করছে। কে সেই ইজারাদার, তা জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিতে বলে সে।

একপর্যায়ে ওই লাঠিয়ালদের অনুসরণ করে ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থান নেয় কালবেলার টিম। পণ্যবাহী গাড়ি এলেই হামলে পড়তে দেখা যায় তাদের।

২৭ আগস্ট রোববার, সময় রাত সাড়ে ১০টা। বংশাল থানাধীন গুলিস্তান-নয়াবাজার সড়কে অবস্থান করে পাওয়া যায় ইসমাইলসহ সেই লোকদের। এর ১৫ মিনিট পর তারা লাঠি দিয়ে আটকাল একটি পিকআপভ্যান। চালক রিজাউল মাতবরের কাছে দাবি করল ১৫০ টাকা। তিনি দিতে না চাইলে লাঠির আঘাত শুরু হলো গাড়ির সামনের গ্লাসে। একপর্যায়ে চালক গাড়ি থেকে নেমে তর্কে জড়ালেন। টাকা না দিলে তাকে মারধর আর গাড়ি ‘খেয়ে’ দেওয়ারও হুমকি দিল লাঠিয়ালরা। তখন চালক চিৎকার শুরু করেন। সেখানে পুলিশ উপস্থিত হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

রিজাউল মাতবর কালবেলাকে বলেন, নবাবপুর থেকে মালপত্র নিয়ে তিনি প্রায় প্রতিরাতেই ওই সড়ক ব্যবহার করেন। প্রতিদিনই টোলের নামে চাঁদা দিতে হয়। ১০০ টাকা থেকে কখনো ৩০০ টাকা দাবি করে এই চাঁদাবাজরা।

৩ সেপ্টেম্বর রোববার, সময় রাত সাড়ে ১০টা। রাতের ঢাকায় টোলের নামে চাঁদাবাজদের দাপট দেখতে এই প্রতিবেদক রাজধানীর নবাবপুর থেকে চড়ে বসেন একটি পিকআপভ্যানে। উদ্দেশ্য বাবুবাজার পর্যন্ত। ঢাকা মেট্রো-ন ১৯-৬৯৩১ নম্বরের ওই পিকআপভ্যানের চালক মো. পারভেজ। তার পাশে বসে যাত্রা শুরু। সেটি একটু এগিয়ে গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট পার হয়ে মূল সড়কে উঠতেই আটকে দেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। নিয়ে নেন কাগজপত্র। নেমপ্লেটে দেখা যায় তার নাম জাহাঙ্গীর। সঙ্গে ছিলেন এক কনস্টেবল। কাগজপত্র যাচাই করে সব ঠিকঠাক পেয়ে এবার চা খেতে চাইলেন ৩০০ টাকা। চালক পারভেজ জানালেন, তার কাছে টাকা নেই। শেষ পর্যন্ত দাবি করা হলো ১০০ টাকা। তা দিয়েই নিস্তার চালকের।

এরপর চালকের পাশের আসনে বসে ছুটে চলা শুরু। চলতে থাকে কথা। চালক পারভেজ বলছিলেন, তারা অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। বাঁশ দিয়ে, লাঠি দিয়ে থামানো হয় গাড়ি। ১০০ টাকা দাবি করে সেই লাঠিয়ালরা। পণ্যবোঝাই থাকলে বড় ট্রাকে দিতে হয় ৩০০ টাকা পর্যন্ত। কথা বলতে বলতে পিকআপটি চলে যায় বাবুবাজার ব্রিজের কাছে। সেখানেই পড়তে হয় লাঠিয়ালদের তোপের মুখে। টোলের নামে তারা দাবি করে ১০০ টাকা। সেই টাকা দিয়েই মেলে রক্ষা।

ওই চালকের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণের সড়কগুলো ঘুরে দেখা গেল এই টোলবাজদের সঙ্গে রয়েছে পুলিশের সখ্যও। রাতে পণ্যবাহী গাড়ি চালাতে নানা অজুহাতে রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা পুলিশকেও দিতে হয় চাঁদা।

৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার, রাত ১১টা। এবার গন্তব্য শনির আখড়া। নয়াবাজার থেকে চলা শুরু করে দয়াগঞ্জে দেখা মেলে লাঠিয়াল টোলবাজদের। সেখানে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে নেওয়া হয় টাকা। এতে সড়কেও লেগে থাকে গাড়ির জট। একই দৃশ্য দেখা গেল টিকাটুলী ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার পার হয়ে শনির আখড়া এলাকায়ও। সেখানে পুলিশের সামনেই টোলের নামে চাঁদাবাজি করছিল লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব কালবেলাকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ঢাকা দক্ষিণের সড়কে টোলের নামে এই অরাজকতা চলছে। আমরা এগুলো বন্ধের জন্য বারবার সিটি করপোরেশনে গিয়েছি, পুলিশকে বলেছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু টোলবাজদের হাত থেকে তাদের রক্ষা হচ্ছে না। তারা অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন, এখন সবকিছু মেনেই গাড়ি চালাতে হচ্ছে।’

তিনি জানান, তাদের কাছে সঠিক হিসাব না থাকলেও প্রতিরাতে কয়েক হাজার পণ্যবাহী গাড়ি চলে। এসব গাড়ির মধ্যে যেগুলো বাবুবাজার ব্রিজ বা পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যায়, গাড়িপ্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা টোলের নামে চাঁদা দিতে হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঢুকতে দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, সায়েদাবাদ ও শনির আখড়ায় এই চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন তাদের চালকরা।

কারা নেয় এই চাঁদা : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রতিবছর দরপত্রের মাধ্যমে টোল আদায়ে ইজারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে সাড়ে ৫ কোটি টাকায় রাজধানীর গুলশানের সাদ্দাম স্টেশনারি নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই ইজারা নিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নিলয় মাহমুদ। অন্য একজন ইজারাদার ৭-ইলেভেনের স্বত্বাধিকারী আফতাব উদ্দিন মাসুদ। তবে তাদের নেপথ্যে অর্থ লগ্নি করেছেন আরও পাঁচজন। তাদের মধ্যে একজন পরিবহন ব্যবসায়ী এবং একজন ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক নেতা রয়েছেন। একটি সিন্ডিকেট করে তাদের লোকজন দিনে-রাতে ঢাকার সড়কে টোলের নামে চাঁদাবাজি করছেন।

কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশনের মূল ইজারাদাররা এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালীদের হাতে সাব-ইজারা দিয়েছেন। ওই সাব-ইজারাদাররা এলাকার সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীদের দিয়ে রাতে টোলের নামে চাঁদা আদায় করছেন। এসব কাজে ঢাকা দক্ষিণের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও কর্মীরা যুক্ত।

গাড়ি আটকে চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দৈনিক ভিত্তিক টাকা পায়। চাঁদা তুলে দেওয়ার কাজ করায় প্রতি রাতে তারা ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা করে পেয়ে থাকে। টোলের নামে সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় হয় গুলিস্তান এলাকায়। ওই এলাকার মধ্যে কাপ্তান বাজারেই প্রতি রাতে ওঠে ১০ লাখ টাকার বেশি। ওই এলাকায় রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত চলা মুরগি বিক্রির প্রতিটি দোকান থেকে ৪ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। কাপ্তান বাজার এলাকায় চাঁদা তোলার নেতৃত্ব দেন রাসেল, বাচ্চু, নুর জাহান আলী ও রহমান। গুলিস্তান এলাকার নেতৃত্বে রয়েছে মনসুর আহমেদ, আবুল হোসেন, ইসমাইল আহমেদ ও মো. রিপন। তাদের হয়ে কাজ করে শতাধিক আদায়কারী। তবে ওই এলাকায় নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মন নামে এক ব্যক্তি পুরো টোল আদায়ের সমন্বয় করেন। আফতাব উদ্দিন মাসুদের লোকজনের নিয়ন্ত্রণ সায়েদাবাদ, টিকাটুলী, দয়াগঞ্জ থেকে শুরু করে শনির আখড়া পর্যন্ত। অন্যরা থাকেন নেপথ্যে।

নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মন কালবেলাকে বলেন, তারা বৈধভাবে অর্থ লগ্নি করে সিটি করপোরেশনের টোলের ইজারা নিয়েছেন। অথচ নির্ধারিত এলাকায় তারা টোল আদায় করতে পারছেন না। তাদের নামে রসিদ ছাপিয়ে অন্যরা চাঁদাবাজি করছে। এর দায় পড়ছে তাদের ওপর। বিষয়টি সিটি করপোরেশন ও পুলিশকেও জানানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

তিনি অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কাপ্তান বাজারের মুরগি মার্কেট, কবুতর মার্কেটসহ পুরো এলাকায় তাদের টোল নেওয়ার কথা। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের জন্য তারা ওই এলাকার টোল পাচ্ছেন না। কাউন্সিলরের লোকজন টোলের নামে টাকা নিলেও দোষ পড়ছে তাদের।

কী আছে ইজারা চুক্তিপত্রে : সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ইজারাদারদের চুক্তিপত্র ও কার্যাদেশের একটি কপি এসেছে কালবেলার হাতে। তাতে টোল আদায়ে ইজারাদারদের ২২টি লিখিত শর্ত বেঁধে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। চলন্ত গাড়ি থামিয়ে টোল আদায় করা যাবে, তা এই শর্তগুলোর কোথাও উল্লেখ নেই। ওই চুক্তিতে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসের নাম উল্লেখ করে টোল আদায়ের কথা বলা হলেও পণ্যবাহী ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানের কথা বলা নেই। বলা হয়েছে, নির্ধারিত রুট ও স্থান ছাড়া রাজস্ব আদায় করা যাবে না। সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে ১০ টাকা ও পিকআপ থেকে ৩০ টাকা নেওয়ার কথা থাকলে এসব বাহন থেকে নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা ও ১০০ টাকা করে। ৬ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, রাজস্ব আদায়ের রসিদ বইয়ে সিটি করপোরেশনের বাস টার্মিনাল শাখার কর্মকর্তার সিলযুক্ত প্রত্যয়ন থাকতে হবে। কিন্তু কালবেলার কাছে থাকা রসিদে এ ধরনের কোনো সিল বা স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। কুলিদের ফির পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়ে ১১ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, কোনো যাত্রী সামান্য মালপত্র ওঠানো বা নামানোর জন্য কুলিদের সাহায্য না চাইলে কোনো কুলি তা স্পর্শ বা মজুরি দাবি করতে পারবেন না। তবে সরেজমিন দেখা গেছে, মালপত্র হাতে বহন করলেও টোলের নামে কুলির মজুরি নিচ্ছে ইজারাদারের লোকজন! ১২ নম্বর শর্তে রাজস্ব আদায়ে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না বলে উল্লেখ থাকলেও টোলবাজরা অহরহই গাড়ির গ্লাস ভাঙছে চাঁদা না পেয়ে। টোল আদায়ের হার আর কুলি মজুরি প্রকাশ্যে টানানোর নির্দেশনা থাকলেও তা পাওয়া যায়নি কোথাও।

এসব বিষয়ে জানতে পাঁচ দিন ধরে ইজারাদার সাদ্দাম স্টেশনারিজের স্বত্বাধিকারী নিলয় মাহমুদের প্রতিষ্ঠানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি বিদেশে আছেন বলে জানানো হয়। তিনি ফিরলে এ বিষয়ে ফোন দিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়। যদিও তার ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, তিনি দেশেই রয়েছেন।

৭-ইলেভেনের স্বত্বাধিকারী আফতাব উদ্দিন মাসুদ দাবি করেন, তারা সিটি করপোরেশনের শর্ত মেনেই রাজস্ব আদায় করছেন। তাদের কেউ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নয়। যদিও ওই সিন্ডিকেটের একজন সদস্য কালবেলাকে বলেন, তারা কাগজে-কলমে যে টাকায় ইজারা নিয়েছেন, এর চেয়ে বেশি দিতে হয়েছে নানা জায়গায়। টোল আদায়ের টাকা থেকেও মাসভিত্তিক থানা পুলিশ থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাদের দিতে হয়। এরপর তাদের লগ্নির টাকা তুলতে হচ্ছে। এজন্য কোথাও কোথাও কিছুটা অনিয়ম থাকতে পারে।

কী বলছে সিটি করপোরেশন ও পুলিশ: টোলবাজদের চাঁদাবাজির সময়ে বিভিন্ন স্পটে পুলিশ সদস্যেরও অবস্থান দেখা গেছে। তবে চাঁদাবাজি বন্ধে তাদের নিবৃর্ত্ত করতে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর থানা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, টোলের নামে চাঁদা আদায়কারীদের বিরুদ্ধে তারা মাঝেমধ্যেই অভিযান চালাচ্ছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণের বিভিন্ন জায়গায় বখাটে ও মাদকাসক্ত এক শ্রেণির লোক টিকিট দিয়ে সিটি করপোরেশনের নামে চাঁদাবাজি করে। এরা মুখে বাঁশি ও হাতে লাঠি নিয়ে চাঁদাবাজি করে। হেঁটে হাতে বা মাথায় করে পণ্য নিয়ে যাওয়া লোকজনও এদের চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। ট্রাক থেকে শুরু করে সব যানবাহনে এই চাঁদাবাজি চলছে। দক্ষিণ সিটি নির্দিষ্ট রুটে ও নির্দিষ্ট পরিবহনে এই রাজস্ব আদায়ের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু চাঁদাবাজরা গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া থেকে বিস্তীর্ণ এলাকায় সব নিয়ম ও সীমা লঙ্ঘন করে রাজস্ব আদায়ের নামে চাঁদাবাজি করছে। এই চাঁদাবাজদের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই ইজারাদারদের বিষয়ে নজরদারি থাকা উচিত। পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটরাও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে সড়কে স্বস্তি আসবে।

ডিবির লালবাগ বিভাগের স্পেশাল টিমের এডিসি রাকিবুল হাসান কালবেলাকে বলেন, টোল আদায়ের নামে এই চাঁদাবাজরা শুধু পণ্যবাহী গাড়িই নয়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতকারী প্রবাসীদের বহন করা গাড়ি আটকেও চাঁদাবাজি করে থাকে। এতে দেশে এসে প্রবাসীরা বাড়ি ফেরার সময় আতঙ্কিত হন। সম্প্রতি এই চক্রের চারজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে বিস্তারিত তথ্যও পাওয়া গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরাও বিষয়গুলো নিয়ে অতিষ্ঠ। সবকিছুরই শেষ আছে। এখন যারা ইজারাদার, তাদের সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ পেয়ে ইজারাদারদের ডেকে এনে সতর্ক করা হয়েছে। এর পরও অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি চুক্তির শর্তেই রয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘সি’ ক্যাটাগরি থেকে বিসিবির পরিচালক পাইলট

কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশ-সৌদি আরব প্রথমবারের মতো চুক্তি স্বাক্ষর

সরকারি অনুষ্ঠানে মুজিব শতবর্ষের লোগো সংবলিত লিফলেট বিতরণ

ইসলামী ব্যাংকে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নিয়োগের দাবি

ফুটবলের সঙ্গে আবেগ-ভালোবাসা মিশে আছে : বাসস চেয়ারম্যান

আন্দোলনের মুখে শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া নিয়ে নতুন প্রস্তাব

পবিত্র কোরআন অবমাননার বিচারের দাবিতে জবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ব্লাড সুগার বাড়ানো থেকে রক্ষা পেতে বাদ দিন সকালের ৪ খাবার

আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, চার ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে

শেখ হাসিনার বিষয়ে দুই দেশকে কী করতে হবে, জানালেন বিক্রম মিশ্রি

১০

দাফনের ১৯ দিন পর স্কুলছাত্রীর লাশ উত্তোলন

১১

ভালোবাসার শিখরে থেকেই বিদায় নিতে চান তাহসান

১২

ছাত্রদলে যোগ দিলেন বৈষম্যবিরোধীর পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী

১৩

বিচ্ছেদের পথে থাকে যেসব ছোট ছোট কারণ

১৪

দেশের জন্য উৎসর্গ প্রাণ, বাবার দেখা হলো না সন্তানের মুখ

১৫

সব দল একমত হলে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া সম্ভব : গোলাম পরওয়ার

১৬

ডা. আজিজুর রহমান মারা গেছেন

১৭

নির্বাচনী জোটে যাওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস

১৮

তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রশংসায় শিশির মনির

১৯

বিসিবি নির্বাচন / ভোট গণনার সময় যে বার্তা দিলেন তামিম

২০
X