মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে আওয়ামী লীগের মধ্যে ফুরফুরে ভাব এলেও এসব বিষয়কে পাত্তা দিতে চাইছে না বিএনপি। কূটনৈতিক শিষ্টাচারমূলক এসব আচরণে বর্তমান সরকারের প্রতি পশ্চিমাদের মনোভাব বদলে গেছে বলে মনে করেন না তারা। এসব ভেবে সময় নষ্ট না করে একদফার আন্দোলন জোরদার করতে চায় দলটি।
বিএনপি নেতারা জানান, সরকার পতনের আন্দোলনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঢাকামুখী করতে এরই মধ্যে তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। তার আগে আগামী ১৬ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পাঁচ বিভাগে তারুণ্যের রোডমার্চ সফল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালিত হবে। এ ছাড়া গত সোমবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত রাতেও স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলোর মতামত নিয়ে আজকালের মধ্যেই পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।
গত ৯-১০ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জোট জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগদান করেন। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি তোলার বিষয়টি। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের এই আচরণ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য কোনো বার্তা নাকি শুধুই সৌজন্য, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়।
তবে এসব আলোচনাকে পাত্তা না দিয়ে বিএনপি বলছে, যেই আমেরিকাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেলফি তোলে প্রচার করাটা আওয়ামী লীগের দৈন্য দশার প্রমাণ। কারণ দেশে গণতন্ত্র থাকলে এবং জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক থাকলে বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তোলে সেটি প্রচার করা লাগত না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর সেলফি তোলা প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ নিজেরাই বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া।
বিএনপি নেতারা আরও বলছেন, একদফা দাবি আদায়ে কোনো উসকানিতে পা না দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন তারা। এখনই হরতাল বা জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো কঠোর কর্মসূচিতে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোই বিএনপির লক্ষ্য।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সেলফি এই সরকারকে রক্ষা করতে পারবে না। ক্ষমতাসীনরা এত দেউলিয়া ও নিঃস্ব হয়ে গেছে যে, বাইডেনের সঙ্গে একটা সেলফি তুলে এখন ঢাকঢোল পেটাচ্ছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী কদিন আগেই বলেছেন যে, আমেরিকা নাকি সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিতে চায় এবং তিনি সেন্টমার্টিন দ্বীপ দিচ্ছেন না বলেই আমেরিকা তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়। এখন সেলফি দেখে কী বুঝব আমরা, আপনি সেন্টমার্টিন দ্বীপ দিয়ে দিয়েছেন?’
মির্জা ফখরুল প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এটা যুক্তরাষ্ট্র। সেলফির জন্য র্যাবের ওপর থেকে স্যাংশন উঠে যায়নি, ভিসা নীতির পরিবর্তন হয়নি, নতুন ডেমোক্রেসি কনভেনশন ডেকে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সুতরাং ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। কারণ বাইডেন বা আমেরিকা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি। তারা বাংলাদেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব তাই বলছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সবার দাবি একটাই, অবিলম্বে পদত্যাগ ও সংসদ বিলুপ্ত করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। আগে ভোটটা ঠিকমতো হওয়ার ব্যবস্থা করেন। তা না হলে কোনো বাইডেন বা সেলফি রক্ষা করতে পারবে না। কঠোর আন্দোলনে এই সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু গতকাল মঙ্গলবার কালবেলাকে বলেন, ‘গ্রামের কোনো কর্মী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে সিনিয়র কোনো নেতার সঙ্গে ছবি তুলতে পারলে এলাকায় গিয়ে তা বলতে পারে ও প্রচারণা চালায়। শেখ হাসিনার সেলফি তোলাটাও তেমনই বিষয়। ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেলফি তুলে আবার প্রচারণা চালান। আমার প্রশ্ন, গণতন্ত্রহীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বাইডেনের সঙ্গে জোর করে সেলফি তুলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি সব সময় দেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষায় সচেষ্ট। এবারও দেশের মানুষ এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। খুব শিগগিরই সবার ঐক্যবদ্ধ ও কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটানো হবে।’
বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সেলফি প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ, জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেলফি তুলে সেটা প্রচার করা আওয়ামী লীগের দৈন্যদশাকেই বোঝায়।’
তিনি বলেন, ‘মূলত জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ সরকার ওই সেলফি দিয়ে তার নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে চাইছে। অথচ এই প্রধানমন্ত্রীই কিন্তু কয়েক মাস আগে আমেরিকা নিয়ে বিভিন্ন রকম বাজে মন্তব্য করেছেন। তিনি আমেরিকাকে গালি দিয়ে বলেছেন, আমেরিকা নাকি তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, তারা সেন্টমার্টিন দ্বীপ চায়, এই অঞ্চলে নৌঘাঁটি গাড়তে চায়.. ইত্যাদি। এখন আবার সেই প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলে প্রচারণা চালান! এটি সত্যিকার অর্থেই আওয়ামী লীগের দৈন্যদশার লক্ষণ। এগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে কী হচ্ছে, তা সময়ই বলে দেবে।’
নোয়াখালী জেলা বিএনপির উপদেষ্টা প্রকৌশলী আমিরুল মোমিন বাবলু কালবেলাকে বলেন, ‘আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিকাশে সেলফি হলো সৌজন্যতার প্রতীক। এটি নিয়ে রাজনীতির কী আছে? আসলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এমন তলানিতে গেছে যে, তারা জনগণকে শোষণ করতে করতে এখন রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী যেই আমেরিকা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন, সেদেশের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে সেলফি তুলে তা প্রচার করে বেড়ান। এটা স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের জন্য কষ্টের।’
জোরালো হচ্ছে আন্দোলন, ৫ বিভাগে রোডমার্চ:
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহ থেকে বিরতিহীন কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি। আজ-কালের মধ্যেই যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের মতামত নেওয়া হবে। এরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন কর্মসূচি চূড়ান্ত করবেন। একই সঙ্গে তরুণ ভোটারদের সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে বিএনপির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ‘তারুণ্যের রোডমার্চ’ সফল করা হবে। খসড়া সূচি অনুযায়ী, ১৬ সেপ্টেম্বর রংপুর থেকে সৈয়দপুর দশমাইল হয়ে দিনাজপুর, ১৭ সেপ্টেম্বর বগুড়া থেকে সান্তাহার-নওগাঁ হয়ে রাজশাহী, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট, ২৬ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ থেকে যশোর-নওয়াপাড়া হয়ে খুলনা এবং ৩০ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা থেকে ফেনী-মিরসরাই হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রোডমার্চগুলো অনুষ্ঠিত হবে।
মন্তব্য করুন