

রাজশাহীর তানোর উপজেলার কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রামে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনা এখনো স্তব্ধ করে রেখেছে পুরো দেশকে। দুই বছরের শিশু সাজিদ মায়ের সঙ্গে হাঁটার সময় পড়ে যায় একটি পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের গর্তে। দীর্ঘ ৩২ ঘণ্টা চেষ্টার পর বৃহস্পতিবার রাতে তাকে উদ্ধার করা হলেও জীবনের আলো আর দেখা হয়নি তার। এই করুণ মৃত্যুর ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের হৃদয়, সৃষ্টি করেছে শোকের ঢেউ।
শুক্রবার সকাল থেকে ভিড় জমতে থাকে সেই ছোট্ট গর্তটির পাশে—যেখানে থেমে গেছে এক শিশুর শ্বাস। কেউ এসে চোখের জল মুছেছেন চুপিচুপি, কেউবা দূর থেকে ফিসফিসিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহ, এমন মৃত্যু যেন আর কাউকে না দেয়।’ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, মেহেরপুর, জয়পুরহাটসহ নানা জেলা থেকে মানুষ এসেছেন শুধু ওই গর্তটি দেখতে—যেখানে সাজিদের জীবনের অবসান ঘটেছে। গর্তটি ঘিরে যেন এক নিঃশব্দ শোক স্তম্ভ দাঁড়িয়ে গেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৭২ বছর বয়সী ইসরাইল উদ্দিন কাঁপা গলায় বলেন, ‘অনলাইনে দেখে আর ঘরে থাকতে পারিনি। ছেলেটিকে দেখতে পাইনি, তাই এসেছি সে যেখানে পড়ে ছিল, সেটা দেখতে। এই ব্যথা কাকে বোঝাই?’ নওগাঁর নিয়ামতপুর থেকে আসা শহিদুল ইসলাম স্ত্রী-সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বলেন, ‘পুরো জমিটা যেন একটা পুকুর হয়ে গেছে। এমন মৃত্যু কেউ দেখতে চায় না, তবুও এসেছি এই নির্মম বাস্তবতার সাক্ষী হতে।’
মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে আসা সাকিবুল হাসান বলেন, ‘পুরো পরিবার নিয়ে এসেছি। সাজিদের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, আমাদের সবার কষ্ট। যেন নিজের সন্তান হারানোর মতো অনুভূতি।’
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রামের জানাজার মাঠে হাজারো মানুষ হাজির হন ছোট্ট সাজিদের শেষ বিদায়ে অংশ নিতে। এমন কোনো ঘর ছিল না, যেখান থেকে কেউ জানাজায় আসেননি। দোকানপাট বন্ধ, মাঠে কাজ বন্ধ, গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল কান্নায়। মসজিদের মাইকে বারবার ভেসে আসছিল সেই হৃদয়বিদারক ঘোষণা—‘কোয়েলহাট পূর্বপাড়া নিবাসী রাকিব উদ্দিনের দুই বছরের শিশুসন্তান সাজিদ মারা গেছে।’
জানাজার ইমামতি করেন কাজী মাওলানা মিজানুর রহমান। নামাজ শেষে যখন তিনি তাকবির দেন, তখন হাজারো কণ্ঠ একসঙ্গে উঠে আসে দোয়ায়—‘হে আল্লাহ, শিশুটিকে জান্নাত দান করো, তার বাবা-মাকে ধৈর্য দাও।’ কফিনটি যখন কবরের দিকে নেওয়া হচ্ছিল, বাতাস থেমে গিয়েছিল যেন। শুধু কান্নার শব্দ, আর নিস্তব্ধতা। কেউ কথা বলেনি, শুধু চোখের জলেই যেন ভাষা হয়ে উঠেছিল ভালোবাসা ও শোক।
এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে যে বিষয়টি—তা হলো, যেখানে শিশুটি মারা গেছে, সেই গর্তটি দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছেন। যেন কেউই এই নির্মমতার সাক্ষ্য থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারছেন না। শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ সেই গর্ত ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন নীরব শ্রদ্ধা আর কান্না নিয়ে।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাজিদ নিখোঁজ হয়। বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় উদ্ধার করা হয় তার নিথর দেহ। ৪০ ফুট গভীর খনন করে দীর্ঘ ৩২ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় তাকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই মৃত্যু শুধু একটি শিশুর নয়—এটি পুরো জাতির হৃদয়ে এক স্থায়ী ক্ষতের মতো দাগ কেটে গেল। কবরের মাটি চাপা দিল সাজিদের দেহ, কিন্তু তার ছোট্ট মুখটি হয়ে থাকবে একটি প্রশ্নের প্রতীক—‘এমন মৃত্যুর জন্য কি আমরা প্রস্তুত ছিলাম?’
মন্তব্য করুন