

নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের জেরে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতির ফলে দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং ত্রিপুরার আগরতলায় অবস্থিত সহকারী হাইকমিশনের সব ধরনের কনস্যুলার সেবা ও ভিসা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য এক সূত্র কালবেলাকে জানায়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এ সেবাগুলো বন্ধ থাকবে। এদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসা কেন্দ্র বন্ধ করে দেয় ভারতীয় বিক্ষোভকারীরা।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কনস্যুলার সেবা বন্ধ করলেও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন সূত্র জানায়, নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকা সত্ত্বেও মানবিক কারণে ভিসা কেন্দ্র খোলা রাখছে তারা। ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, অনেক ভিসা আবেদনকারী গুরুতর রোগের চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছেন। এই মানবিক চাহিদাকে মাথায় রেখে ভারতীয় হাইকমিশন ঢাকা, খুলনা, সিলেট এবং রাজশাহীতে ভিসা কেন্দ্রগুলো চালু রেখেছে। তবে চট্টগ্রামের আইভ্যাক সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। ১৮-১৯ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের সহকারী হাইকমিশনের প্রবেশপথে জনতার হামলা, পাথর নিক্ষেপ এবং প্রবেশপথ ভাঙার হুমকির কারণে এটি বন্ধ করা হয়।
গত শনিবার নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে কিছু ভারতীয়। এ ঘটনার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ঘটনাটি নিয়ে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রচার লক্ষ করা গেছে। প্রকৃতপক্ষে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে ২০-২৫ জন যুবক জড়ো হয়ে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে স্লোগান দেয় এবং বাংলাদেশে সব সংখ্যালঘুর সুরক্ষার দাবি তোলে। এ নিয়ে দিল্লিতে সাংবাদিকরা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি যে জবাব দেন, তার লিখিত রূপ নিজের এক্স হ্যান্ডলে প্রকাশ করেন। রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশ দূতাবাসের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙার চেষ্টা বা নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত পুলিশ কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই দলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসব ঘটনার দৃশ্যমান প্রমাণ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা তুলে ধরছেন। দীপু দাসের বর্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য আমরা জোরালো অনুরোধ করেছি।’
এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভের ঘটনায় প্রেস নোটের মাধ্যমে দেওয়া দিল্লির ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছে ঢাকা। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি দিল্লি যেভাবে উপস্থাপন করছে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। দিল্লির কূটনৈতিক এলাকায় বাংলাদেশ মিশন অত্যন্ত নিরাপদ স্থানে অবস্থিত। সেখানে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশ কীভাবে সম্ভব হলো, তা প্রশ্নবিদ্ধ। এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত।’
এদিকে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বেড়েছে। গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। পরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে দূরত্ব বাড়তে থাকে ভারতের সঙ্গে। এরপর নানা ইস্যুতে দুদেশের উত্তেজনা চলে। সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদি হত্যাসহ নানা ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে।
এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল অবস্থানে রয়েছে, তবে সাম্প্রতিক নানা ইস্যু এই সম্পর্ক আরও উত্তেজনাপূর্ণ করেছে। নতুন করে কনস্যুলার সেবা বন্ধ রাখার বিষয়টি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আরও একটি নতুন ধাপ। এখন বাংলাদেশিদের জন্য তারা সব ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে অনেকেই নানা সমস্যায় পড়বে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে প্রতিবেশীদের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের সুযোগে কেউ কেউ দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের ঘটনার প্রতিবাদে শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্কে জমায়েত হন বিএইচপি, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, শিলিগুড়ি মহানগর সংগঠনের শ তিনেক সদস্য। এরপর তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বাংলাদেশের ভিসা অফিস ঘেরাও করেন। বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ, দিপু দাসের হত্যার বিচার ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান।
পরে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পাঁচজনের একটি প্রতিনিধিদল ভিসা অফিসে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এবং প্রতিবাদস্বরূপ ভিসা অফিস বন্ধ রাখতে বলে। বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে জানানো হয়, তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে জানাবেন। বাংলাদেশে তাদের হিন্দু ভাইদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। এখান থেকে যেন কোনো ভারতীয়, কোনো হিন্দু বাংলাদেশে না যায়, ব্যবসা না করে, সেটা তারা চান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কালবেলাকে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে চলমান অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে দিল্লির পাশাপাশি আগারগাঁওয়ের ও কনস্যুলার সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কনস্যুলার সেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন