সরকারবিরোধী বিএনপি জোট চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ফলে এসব সিটি নির্বাচন শুরু থেকেই জৌলুস হারায়। এর মধ্যে গাজীপুরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হারলেও বাকি চার সিটিতে অনেকটাই সহজ জয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে বরিশালে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলে তেমনটা আর দেখা যায়নি। সেখানে অন্যতম শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের ওপর ভোট চলাকালীন হামলার ঘটনার পর বাকি দুই সিটি রাজশাহী ও সিলেটে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় দলটি। ফলে এসব সিটিতে অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচনে বিপুল ভোটে
জয়ী হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। এদিকে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন স্বচ্ছ হয়। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা জয় লাভ করেছি। এই নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো কথা, কোনো অভিযোগ করতে পারবে না।’ সিটি নির্বাচনের সার্বিক চিত্রে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশনও। এ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
তবে ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজপথের বিরোধী দলহীন এসব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলেও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন ইসির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে বলে মত বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, সরকারবিরোধী বিএনপি জোট এসব ভোটে অংশ না নেওয়ায় যেমন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি, তেমনি ভোটার উপস্থিতিও ছিল কম। ফলে সরকারবিরোধীদের নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচন বিশ্লেষক মুনিরা খান কালবেলাকে বলেন, স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে অনেক তফাত আছে। স্থানীয় তথা সিটি নির্বাচনকে নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। নির্বাচন কমিশন বলছে তারা সিটি নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্ট। তবে সিটি নির্বাচন নিয়ে ইসির সন্তুষ্টি শেষ কথা নয়। অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আমরা আশা করব জাতীয় নির্বাচন নিয়েও তারা সন্তুষ্টির কথা দৃঢ়ভাবে বলতে পারবেন। সিটি নির্বাচনে না হলেও জাতীয় নির্বাচন সবার অংশগ্রহণমূলক হবে এবং সেই নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ভোটার উপস্থিতিও নিশ্চিত করা হবে। তার জন্য কমিশন যা যা করার তার সবই করবে বলে আমরা আশা করি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, আপাত দৃষ্টিতে এসব সিটি নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ হলেও সেটি আসলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ, নির্বাচনের জন্য শক্ত প্রার্থী ও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকতে হয়। আর বিকল্প না থাকলে সেটিকে গ্রহণযোগ্যও বলা যায় না। এ নির্বাচনে ভোটারদের সামনে তেমন কোনো বিকল্প ছিল না। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের বিপরীতে অনেকটাই নামসর্বস্ব দল এসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। গাজীপুরে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল একই দল সমর্থিত। সেখানে বিরোধীরা ছিল না। বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বড় কোনো দল অংশ নেয়নি। তবুও নির্বাচন কমিশন তাদের সন্তুষ্টির কথা বলছে। এ নির্বাচনে পালাবদলের সুযোগ না থাকায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। জাতীয় নির্বাচন অনেক দলের জন্য অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্ন। সেখানে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী কী করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেজন্য আগামীতেও জাতীয় নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হবে—এই নির্বাচন সেই বার্তা দেয় না। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের হিসাব-নিকাশও ভিন্ন।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, এসব নির্বাচন ছিল রুটিন নির্বাচন। এর মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনাও ছিল না। ফলে ভোটে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনার সন্তুষ্ট হলেও দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ না নেওয়ায় দেশের বেশিরভাগ মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ফলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। এর আগে ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনগুলোতে, বিশেষ করে বিএনপি যেসব নির্বাচনে অংশ নেয়, সেসব নির্বাচনের আগের রাতে বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রায় এলাকা ছাড়া করে দেয় পুলিশ বাহিনী। এবার বিএনপি না থাকায় প্রশাসন তেমনটি করেনি এবং সেজন্যই হয়তো নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছে; কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে সেটি সম্ভব নাও হতে পারে। দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী মারমুখী এবং প্রশাসন আগের মতোই হস্তক্ষেপ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন দর্শকের ভূমিকা পালন ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারবে বলে মনে হয় না। এ ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে সরকারবিরোধী জোট নির্বাচনে অংশ নেবে বলে মনে হয় না। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা ইসির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে।
তবে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের সহযোগিতায় সংসদের উপনির্বাচন এবং সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করে আসছে। গাজীপুর সিটিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হেরেছে। আবার বাকি চার সিটিতে তারা জয়ী হয়েছে। এ জয়-পরাজয় গণতন্ত্রের এপিঠ-ওপিঠ। গণতন্ত্রকে মানতে হলে জয়-পরাজয় মেনে নিতে হবে। বর্তমান কমিশনের ইচ্ছা ও দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তারা জাতির মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করতে পেরেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব নির্বাচন ইসির সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছে। তিনি আরও বলেন, কোনো দল সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো দাবি করলে তা ইসি ও সরকারের পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। কারণ, তারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমি আশা করি, সব রাজনৈতিক দল সংবিধানের মধ্যে থেকেই জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে। আর নির্বাচন কমিশনও সংলাপসহ নানা প্রক্রিয়ায় মাঠ তৈরি করবে। এর মধ্য দিয়েই সমাধান বের হয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।
মন্তব্য করুন