রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল গতকাল রোববার খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ফলে এখন জামায়াত দলীয়ভাবে কিংবা দলীয় প্রতীক (দাঁড়িপাল্লা) নিয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। জামায়াতের দাবি, নিবন্ধন নিয়ে বিচলিত নয় তারা। আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রে নিবন্ধন কোনো জরুরি বিষয় নয়। নিবন্ধন শুধু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দলটির দাবি, আপিল খারিজ হলেও তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারবে।
জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আপিল খারিজ হলেও তা চলমান আন্দোলন-কর্মসূচিতে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তাদের পূর্বঘোষিত ১০ দফা দাবি আদায়ে রাজপথের কর্মসূচিকে আরও জোরদার করবে দলটি। জামায়াতের নেতাদের দাবি, বর্তমান সরকার দেশে যে ফ্যাসিবাদ রাজত্ব কায়েম করেছে তাদের নিবন্ধন নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তে তা আবারও প্রমাণিত হলো। এতে দলের নেতাকর্মীদের ক্ষোভ আসন্ন নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, জামায়াতের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বক্তব্য না শুনে ‘পিটিশন ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ হিসেবে আপিল মামলাটি খারিজ করে দেওয়ায় জামায়াত ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটি একটি ন্যায়ভ্রষ্ট রায়। আমরা এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি। দলের আইনজীবীরা আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। আমরা মনে করি আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে এ ন্যায়ভ্রষ্ট রায় দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ সম্পৃক্ত রয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলতি বছরের শুরু থেকে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছে জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এরই মধ্যে তারা ৫ দফায় অবরোধ কর্মসূচি পালনের পর বর্তমানে হরতাল কর্মসূচি পালন করছে।
দীর্ঘ এক দশক পর গত ১০ জুন রাজধানীতে বড় সমাবেশের পরই মূলত আবারও আলোচনায় আসে জামায়াত। সে সময় অনেকেই বলেছেন বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির কারণেই জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া সরকারের সঙ্গে জামায়াতের গোপন যোগাযোগ হয়েছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতকে নাকচ করে দিয়েছেন। বিএনপির মতে, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের যোগসাজশ থাকতে পারে।
নিবন্ধনের আপিল খারিজ প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, আওয়ামী লীগ জামায়াতের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তাকে ভয় পেয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করে এ নিবন্ধনের আপিল পিটিশনটি বাতিল করেছে। জামায়াতে মনে করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অবৈধভাবে এই রায় দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সেটা জামায়াত মোকাবিলা করবে।
জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেই। তবে নীরবতাকে কাটিয়ে উঠতে জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা ১০ জুন ঢাকায় সমাবেশের পর বিভাগীয় সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয় এবং কর্মসূচি ঘোষণা করে। মূলত নবোদ্যমে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু করাটাই জামায়াতের অন্যতম লক্ষ্য। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা ভেবেছিলেন, পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে প্রশাসন বাধা দেবে না। তবে বাধা দিলে এ ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশলে হলেও মাঠে থাকবে জামায়াত। অবশ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগে সমাবেশ করার বিষয়ে
পুলিশ-প্রশাসনকে অবহিত করে চিঠি দিলেও কোনো বিভাগেই সমাবেশ করতে পারেনি দলটি। এরপর থেকেই দলটির নেতাকর্মীরা নিজস্ব আঙ্গিকে সাংগঠনিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন।
জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল দলের নীতিনির্ধারকরা। আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বিএনপির মতো তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। জামায়াতের কয়েকজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কালবেলাকে বলেন, চলমান আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এই সরকারের পতন। এ ছাড়া তাদের দাবির মধ্যে আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, দলের আমির শফিকুর রহমাসনসহ রাজবন্দিদের মুক্তি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মতো জনসম্পৃক্ত বিষয়গুলো।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এইচএম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, মানুষের ভোটাধিকার আদায়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। এটা সামনে আরও জোরদার হবে। দলের নিবন্ধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলের নিবন্ধন তো শুধু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে নিবন্ধনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সুতরাং আন্দোলন কর্মসূচিতে এর প্রভাব পড়বে না। বরং জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ আবারও প্রমাণিত হলো।
জামায়াতের কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা কালবেলাকে জানিয়েছেন, সমমনা ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যমে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তারা তৎপর আছেন। বিশেষ করে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। উভয় দলই সরকাবিরোধী মনোভাব নিয়ে নিজস্ব অবস্থানে রয়েছে। তবে এ দুই সংগঠনের সঙ্গে কোনো জোট গড়ার সম্ভাবনা নেই। বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের ব্যাপারে আন্দোলন-কর্মসূচিতে এ দুই দলের সমর্থন প্রত্যাশা করছে জামায়াত।
জামায়াত সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ৭৬টি আসনে প্রার্থী দিলেও ১০টিতে জয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ২২২টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৮টিতে জয়ী হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে জয়ী হন দলটির প্রার্তীরা। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ১৭টি আসনে বিজয়সহ চারটি সংরক্ষিত আসন পায় দলটি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসনে জয়ী হয়। ওই নির্বাচনে দলটি জোটগতভাবে ৩৯টি এবং চারটিতে এককভাবে নির্বাচন করে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল জামায়াত।