বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি বক্তব্য অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার আবারও নিজেদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে দুপক্ষ। বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বাইডেন প্রশাসন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন। আর যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমারা বাংলাদেশের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দিলে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে মস্কো।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত রুশ ফেডারেশনের রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ভি মন্টিটস্কি বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিরোধী রাশিয়া। জাতিসংঘ ছাড়া অন্য কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞা আমলে নেওয়ার কিছু নেই। পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলে ওই পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকা-মস্কো আলোচনা করবে।
অন্যদিকে ওয়াশিংটনের ফরেন প্রেস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ সমন্বয়ক জন কিরবি দাবি করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা এবং নিখাদ অপপ্রচার। বাংলাদেশের জনগণ যা চায়, যুক্তরাষ্ট্রও তা চায়। আর তা হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এই লক্ষ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও তার টিম কাজ করে যাচ্ছেন।
ঢাকার পাশে থাকবে মস্কো: জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘স্বাধীনতা সাংবাদিক ফোরাম’ আয়োজিত ‘টকস উইথ দ্য অ্যাম্বাসাডর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বের এককভাবে নিষেধাজ্ঞাকে স্বীকৃতি দেয় না রাশিয়া। আমরা শুধু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞাকে মেনে চলি। যদি ওই ধরনের কোনো সমস্যা হয়, ঢাকা ও মস্কো আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করবে আমরা কী ধরনের সহযোগিতা করতে পারি।’
সাংবাদিক শেখ শাহরিয়ার জামানের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম প্রমুখ।
পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে কি না—জানতে চাইলে আলেক্সান্ডার মিন্টিটস্কি বলেন, ‘অবশ্যই করছে। মুখপাত্র (রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের) মারিয়া জাখারোভা তার বিবৃতিতে সম্প্রতি হস্তক্ষেপের বিষয়ে বলেছেন।’
বাংলাদেশের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরপেক্ষ হওয়া উচিত বলে মনে করেন রুশ রাষ্ট্রদূত। ফিলিস্তিন ইস্যুতে রাশিয়া ও বাংলাদেশের একই অবস্থানের কথা উল্লেখ করে মন্টিটস্কি বলেন, ‘ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমারা সরব থাকলেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ভূমিকা নিয়েছে। তারা অভিযোগ করেছিলে, ইউক্রেনে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, এটা নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তবে অক্টোবর থেকে ইসরায়েলে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এটা নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই।’
বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা দেখছি, বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকে যে কোনো ধরনের জোটের বিরোধী অবস্থান। এটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে বলা হয়েছে। এটি অত্যন্ত ভালো। বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এবং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের এটি অব্যাহত রাখা উচিত।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘২০২১ সালে আমাদের মধ্যে বাণিজ্য ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের। পরে এটি ৬৫ কোটি ডলারে নেমে আসে। আমরা বিশ্বাস করি, এ বছর এটি আবারও আগের জায়গায় ফিরে যাবে। রাশিয়ার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে ১০ লাখ টন শস্য এবং ৫ লাখ টন পটাশিয়াম ক্লোরাইড সরবরাহ করতে তৈরি আছে।
বাংলাদেশি দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বিভিন্ন দেশের মতো রাশিয়াতেও রয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, গত জুনে জাহাজ তৈরি ও নির্মাণ শিল্পে কাজ করার জন্য প্রথম ব্যাচের বাংলাদেশিরা রাশিয়ায় গেছে। আমরা আরও বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার জন্য তৈরি।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের বক্তব্যের তথ্য উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত জানান, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী চলছে। রূপপুরের কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। ৮০ জনের বেশি বাংলাদেশি নিউক্লিয়ার স্টাডিজ সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়া রোসাটম কোম্পানি বাংলাদেশে একটি রিসার্চ রিঅ্যাক্টর স্থাপন করতে চায়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে রুশ দূত বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কারিগরি উন্নতির ব্যাপারে আলোচনা শেষ। এখন অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা চলছে। স্যাটেলাইট স্থাপনে বাংলাদেশ সরকার যে দেশকে ভালো অংশীদার মনে করবে, তাকে বেছে নেবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার নেই। এটা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত।
রাশিয়ার অভিযোগ মিথ্যা, বলছে ওয়াশিংটন: এদিকে ওয়াশিংটন ডিসির সংবাদ সম্মেলনে জন কিরবি এক প্রশ্নের জবাবে পিটার হাসের বিরুদ্ধে রাশিয়ার করা অভিযোগকে পুরোপুরি মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, রাশিয়ানরা জানে, এটা মিথ্যা। এটা নিখাদ রাশিয়ান অপপ্রচার।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ সমন্বয়ক আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যা চায়, যুক্তরাষ্ট্রও তা চায়। আর তা হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এই লক্ষ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও তার টিম কাজ করে যাচ্ছেন। তারা বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, বিরোধী দল, সরকারসহ বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবেন। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সম্মান নিশ্চিতে তারা কঠোর পরিশ্রম করে যাবেন।
চলমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কি তার আগের অবস্থান থেকে পিছু হটছে? এমন প্রশ্নের জবাবে কিরবি বলেন, অন্য দেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষ নেয় না। বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতিতে বদল আসেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও তার দল যা করা দরকার, তাই করবে।
উল্লেখ্য, গত ২২ নভেম্বর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো প্রভাব খাটাচ্ছে—অভিযোগ করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা ‘স্বচ্ছতা’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচন নিশ্চিত করার অজুহাতে স্পষ্টই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। অক্টোবরের শেষের দিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও বিরোধী দলের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধির মধ্যে বৈঠকের খবর পাওয়া গেছে। ওই বৈঠকে তাদের মধ্যে দেশে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন আচরণ নগ্নভাবে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন এবং ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।’
গত ২৪ নভেম্বর ওই অভিযোগের খণ্ডিত অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বার্তা দিয়েছিলেন মারিয়া জাখারোভা। গত ২৫ নভেম্বর তার বক্তব্যের পুরো অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে বাংলাদেশের রাশিয়ার দূতাবাস।
এদিকে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র অবগত আছে জানিয়ে গতকাল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো দলকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশের কোনো দলকে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রাধিকার দেয় না। বাংলাদেশের জনগণের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা, শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।’
এর আগেও ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির এক নিখোঁজ নেতার বাড়িতে পিটার হাসের যাওয়ার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছিল রাশিয়া।