সরকারি-বেসরকারিসহ প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই কর্মজীবী নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বিবাহিত নারীরা সেটি পাচ্ছেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বাধ্য হয়েই এই সময়টিতে নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ভাইভা, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট সবকিছুই করতে হচ্ছে তাদের। আবার অনেকে এসব কাজে অংশ নিতে না পেরে পিছিয়ে পড়ছেন। এসব কারণে গর্ভাবস্থায় মাতৃত্বকালীন ছুটি চান বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নারী শিক্ষার্থীরা।
বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে কালবেলা। তারা জানিয়েছেন, গর্ভকালীন পূর্ণ বিশ্রামে থাকার কথা থাকলেও তারা সে সুযোগ পান না। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা না থাকায় এবং ইয়ার ড্রপের ভয়ে অনেক নারী শিক্ষার্থীকেই মিডটার্ম বা সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তারা কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারেননি। এতে তারা ভেঙে পড়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী শাহনাজ আক্তার (ছদ্মনাম) তার মাতৃত্বকালীন গল্প তুলে ধরে বলেন, তৃতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা চলাকালে নিশ্চিত হই যে, আমি অন্তঃসত্ত্বা। এরপর অসুস্থতা শুরু হয়। সে অবস্থায় মিডটার্ম পরীক্ষা দিই। এরপর আর ক্লাসে যেতে পারিনি। তবে কোর্স শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে অসুস্থতা নিয়েই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিই। তিনি বলেন, চতুর্থ সেমিস্টারে ক্লাস করতে না পারায় ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পাইনি। এরপর ফের ভর্তির আবেদন করে বাড়িতে চলে যাই। সেখানেই বাচ্চার জন্ম হয়। এরপর পরের ব্যাচের সঙ্গে ফের ক্লাস শুরু করি। স্বামী চাকরির কারণে নিজ এলাকায় চলে যান। ফলে বাধ্য হয়ে মাকে ঢাকায় আনতে হয় বাবুর দেখাশোনার জন্য। অনেক সময় বাবুকে নিয়েই ক্লাসে যেতে হয়েছে। ক্লাস পরীক্ষার বাইরে সাংসারিক ও অন্য কাজ মিলিয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মতো অবস্থা যাতে অন্য কারও না হয়, সেজন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।
জানা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যের মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান (অনার্স) ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিভাগের ১৮ বছর এবং তার অধিক বয়সী সব শিক্ষার্থীর গর্ভকালীন পরিস্থিতিতে তিন মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর নিয়ম চালু হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। এক্ষেত্রে ছুটির কারণে শিক্ষার্থী যদি কোনো সেমিস্টার পরীক্ষা মিস করেন, পরবর্তী সেমিস্টারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেই বিভাগের প্রধান বা চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে তা সমন্বয় করা হবে। ২০২৩ সালে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার ঘোষণা দেয় দেশটির কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কোনো শিক্ষার্থী ছুটিতে গেলে (ছুটি শেষে) আবার ভর্তি না হয়েই তারা তাদের ক্লাস শুরু করতে পারবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী লাবনী বিশ্বাস বলেন, ‘অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের অবশ্যই মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রয়োজন আছে। আমাদের যখন সপ্তম সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়, তখন আমার গর্ভধারণের সাত মাস চলে। সে অবস্থায়ও হলে থেকে আমার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সিজার হওয়ার পরে বাচ্চার বয়স যখন ২৬ দিন ছিল তখন থেকে আমার অষ্টম সেমিস্টারের টিউটোরিয়াল এক্সাম দিতে হয়েছে। এই পরীক্ষা দেওয়ার ৫-৬ দিনের ভেতরেই ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। তখন বাচ্চাকে রেখে নিয়মিত পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ওই অবস্থায় তো আমি হলে থাকতে পারিনি। তখন চুয়াডাঙ্গা থেকে ১০০-১৫০ কিলোমিটার জার্নি করে কুষ্টিয়া গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এরপর আবার ইন্টার্নশিপ ছিল। সব মিলিয়ে খুবই কষ্ট হয়েছে আমার। ওই সময়টাতে ছুটি হলে ভালো হতো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী তামান্না আফরোজ তাজরিয়ান তার সংকটকালীন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার বেবি কনসিভ হওয়ার পরপরই কোনো এক সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। ওইসময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারের কাছে গেলে আমাকে ডাক্তার ফুল বিশ্রামে থাকার নির্দেশনা দেন। তখন আমি খুব রিস্ক নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। এই সময় আমার ছুটিটা খুব প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে, ডেলিভারির ১২ দিন পরে আমার মিড টার্ম পরীক্ষা ছিল। ওই সময়ও আমার ছুটি প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেটা পাইনি। আমার সংকটকালে বিভাগের দুই-একজন শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু একজন শিক্ষককে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলার পরও তিনি তার কোর্সের এটেন্ডেন্সে আমাকে জিরো মার্ক দিয়েছিলেন।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক নারী শিক্ষার্থীর সন্তান আছে। তাদের অনেকেরই বাচ্চাকে বাসায় রেখে আসার মতো ব্যবস্থা থাকে না। বাধ্য হয়েই বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে আসতে হয়। ফলে বাচ্চার মা মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতে পারেন না। বাচ্চাও তার উপযুক্ত পরিবেশ পায় না। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সন্তানদের জন্য একটি ডে-কেয়ার এবং একটি ফিডিং রুমের ব্যবস্থা থাকাও খুবই প্রয়োজন।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মর্তুজা মেডিকেল সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. রাজিয়া রহমান বলেন, ‘নারী শিক্ষার্থীদের গর্ভকালীন কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে ছুটি তো অবশ্যই প্রয়োজন। বিশেষ করে যখন বেড রেস্ট দরকার। ওইসময় তো আর ক্লাসে যাওয়া সম্ভব হয় না। নারী শিক্ষার্থীদের সংকটকালীন এ মুহূর্তকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি চালুর বিষয়টি খুবই ভালো একটা উদাহরণ। এটা আমাদের দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ফলো করতে পারে। আস্তে আস্তে সবাই সোচ্চার হলে এবং এই দাবিগুলো বারবার যদি উঠতে থাকে, তাহলে মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়টি বাস্তবে রূপ নেবে।’
মানবাধিকার, উন্নয়ন ও সংস্কৃতি কর্মী আসিফ মুনির বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক থাকে এবং এই সময় তাদের বিয়ে ও গর্ভধারণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর গর্ভকালে মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়টা বিবেচনা করা যেতেই পারে এবং এটা হওয়া উচিতও। তবে বিষয়টি যদি ইউজিসির মাধ্যমে পরামর্শ বা বিধিমালা আকারে আসে, তাহলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এটা চালু করতে উদ্বুদ্ধ হবে। এটা যদি করা যায় তাহলে বাংলাদেশের সুনাম হবে। সেটা জেন্ডার বা নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হতে পারে।’
বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে কেউ গর্ভবতী হলে তাকে মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারে। ছুটিতে থাকা অবস্থায় সে বাসায় তার সুবিধা অনুযায়ী পড়াশোনা করবে এবং এই সময়ে কোনো সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা মিস হয়ে গেলে তা কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সেমিস্টার পরীক্ষার সময় নিয়ে নেবে, এরকমটা হতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, ‘শিক্ষার্থীর মাতৃত্বকালের মুহূর্তটা শিক্ষকদের কনসার্নে থাকে। এজন্য তার এটেনডেন্সটা সাধারণত বিবেচনায় রাখা হয়। এটার ধরাবান্ধা কোনো নিয়ম নেই। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা প্র্যাকটিস রয়েছে যে, ক্লাসে উপস্থিতির পরিমাণ সেরকমটা না থাকলেও আমরা তাকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগটা দিই। কারণ, এখানে মানবিক বিষয় রয়েছে।’
মাতৃত্বকালীন ছুটি চালুতে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যখন ছুটি মঞ্জুর হবে, তখন সে ক্লাস করবে না। এজন্য তার পক্ষ থেকে এমন দাবি আসতে পারে যে, আমি তো ছুটিতে ছিলাম, আমি ক্লাস করিনি, আমি পরীক্ষা দিতে পারব না, তখন সে পরীক্ষায় পিছিয়ে যাবে। এই জিনিসগুলো আগে ক্ল্যারিফাই করতে হবে। ৬ মাসের সেমিস্টার ছুটির কারণে পিছিয়ে গেলে তা কীভাবে মেকআপ করব সেটা আগে নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য আগে বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। তারপর যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ কারণে, আগেই মন্তব্য করা কঠিন।’