বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মির চার দিনের মাথায় এসে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে যোগাযোগ। এর আগে সরাসরি যোগাযোগ না হলেও বিভিন্ন মাধ্যমে অডিওবার্তা পাচ্ছিল জিম্মি নাবিকদের স্বজন-পরিবাররা। কিন্তু দিন যত বাড়ছে, ততই কমে আসছে বার্তা আদান-প্রদান। এতে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে সোমালিয়ার গারাকাদ বন্দরের কাছে জাহাজটি নোঙর করা হয়। তবে গতকাল শুক্রবার দুপুরে এটি অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ।
এদিকে এমভি আব্দুল্লাহর সহায়তায় যুদ্ধজাহাজ এবং একটি দূরবর্তী টহল জাহাজ (এলআরএমপি) মোতায়েন করেছে ভারতের নৌবাহিনী। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে ভারতীয় নৌবাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। পোস্টে বলা হয়েছে, সশস্ত্র জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং জাহাজটি সোমালিয়ার জলসীমায় পৌঁছানো পর্যন্ত কাছাকাছি এলাকায় থেকে নজর রাখে ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ।
ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে, বাংলাদেশি জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে দূরবর্তী টহল জাহাজ (এলআরএমপি) মোতায়েন করা হয়। এরপর ১২ মার্চ সন্ধ্যায় জাহাজটির অবস্থান শনাক্ত করার পর জাহাজের নাবিকদের অবস্থা জানতে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু জাহাজ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পোস্টে আরও বলা হয়, এ ঘটনায় পরে ভারতীয় নৌবাহিনী একটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। সেটি ওই অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তায় কাজ করছিল। যুদ্ধজাহাজটি ১৪ মার্চ সকালে ছিনতাইকৃত জাহাজটির মুখোমুখি হয়। বাংলাদেশি জাহাজটি সোমালিয়ার জলসীমায় পৌঁছানো পর্যন্ত কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করে ভারতীয় নৌবাহিনীর এই যুদ্ধজাহাজ।
সোমালিয়ার ছিনতাই হওয়া এমভি আব্দুল্লাহ বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে সোমালিয়ার উপকূল থেকে সাত নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল। সোমালিয়ার গারাকাদ বন্দরের কাছে জাহাজটি নোঙর করা হয়। চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে। এ কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে আরব আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরের দিকে যাওয়ার কথা ছিল, গন্তব্য ছিল দুবাই; কিন্তু মঙ্গলবার সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্ব দিকের মহাসাগরে কয়েকটি স্পিড বোট ও মাছ ধরার বড় নৌকা নিয়ে সশস্ত্র দস্যুরা জাহাজে হামলা চালায়। কয়েক দফা গুলি ছুড়ে জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নেয় দস্যুরা। জিম্মি করে ফেলে জাহাজের ২৩ নাবিককে।
জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তারা দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রায় ৯৬ ঘণ্টা পার হলেও এখনো সোমালীয় জলদস্যুদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি নিজেদের কোনো চাহিদার কথাও জানায়নি তারা। বরং গতকাল বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে জাহাজটি দস্যুরা অন্য একটি জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
গত মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মির পর বুধবার এমভি আব্দুল্লাহর চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাইদুজাম্মান, চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান একাধিক বার্তা পাঠান। কিন্তু পরে তাদের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেয় জলদস্যুরা। মূলত মোবাইল কেড়ে নেওয়ার পর থেকেই পরিবারও স্বজনদের সঙ্গে জিম্মি থাকা নাবিকদের যোগাযোগ কমে আসে। তবে বেশ কয়েকটি সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইল কেড়ে নেওয়া হলেও কৌশলে পরিবার-স্বজনদের বিভিন্ন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন নাবিকরা।
এমভি আব্দুল্লাহর চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খানের মা শাহনূর বেগম কালবেলাকে জানিয়েছেন, বুধবার ছেলের সঙ্গে তার শেষ কথায় হয়। এ সময় আতিক জানিয়েছিল সবাই ভালো আছেন। মায়ের কাছ থেকে দোয়া চেয়েছিলেন। কিন্তু এরপর নানাভাবে চেষ্টা করে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হননি তিনি।
ছল ছল চোখে শাহনূর বেগম বলেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমরা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। কপালে যা আছে; তাই হবে। ছেলের সঙ্গে প্রথম রমজানে কথা হয়েছিল, এরপর আর কথা হয়নি। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। যদি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তাহলে আমাকে একটু জানিয়েন ছেলেটা কেমন আছে।’
ওই জাহাজে ফায়ারম্যান হিসেবে কাজ করতেন চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকার মোশাররফ হোসেন শাকিল। শাকিলের বড় ভাই আবু বক্কর জানিয়েছেন, সবশেষ গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে শাকিলে সঙ্গে তাদের কথা হয়। এ সময় সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার বিষয়টি তিনি পরিবারকে জানিয়েছিলেন। আবু বক্কর বলেন, ‘শাকিলের সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে শেষ কথা হয়। তখন সে বলেছিল সবাইকে একটি কক্ষে আটকে রেখেছে। এ কথা বলে কল কেটে দেয়। পরবর্তী সময়ে রাতে ল্যাপটপের সাহায্যে আমাদের বার্তা পাঠায়। জানায়, সবার মোবাইল কেড়ে নিয়েছে। হয়তো ল্যাপটপও নিয়ে নেবে। আমার জন্য দোয়া করিয়েন।’ একইভাবে জাহাজটির অয়েল ম্যান অভির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অভির সঙ্গেও মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে শেষ কথা হয় পরিবারের।
এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটির নাবিকদের পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিম্মি থাকা নাবিকদের সঙ্গে পরিবারের শেষবারের যোগাযোগ হয়েছে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা আগে। তবে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে এক দফা বার্তা আদান-প্রদান করেছিল। দস্যুদের সঙ্গেও বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে মালিকপক্ষ। কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি। জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি। তারা এখনো কোনো যোগাযোগ করেনি। জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে সবশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কথা হয়েছিল।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) দুপুরে দস্যুরা যেখানে জাহাজটি ভিড়িয়েছিল, সেখান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে বলে খবর পেয়েছি। যাই হোক নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা আমাদের প্রধান লক্ষ্য এবং সেই বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি।