দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে নিজেদের অবস্থানে অনড় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিরোধীদের দাবি, অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এমন পাল্টাপাল্টি ‘একদফা’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এর দিকে মোড় নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দুপক্ষের এ ধরনের অবস্থান সমঝোতার পথ আরও কঠিন করে তুলেছে। অবিলম্বে সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সত্যিকার অর্থেই এ দেশের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও বিদেশিরা। কারণ, আমাদের ভোটাধিকার নেই। আমরা অসহায়। সেজন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না; কিন্তু বিদেশিরা নিষেধাজ্ঞাসহ নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সেজন্য বিদেশিদের দেখানোর জন্য হলেও রাজপথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করেছে দুই দল। তবে সমাবেশে দুই দলের একদফার অনড় অবস্থান রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত করবে।’
সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পরামর্শ দিয়ে এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন পদ্ধতির সমাধান করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে আমাদের পরিণাম আরও ভয়াবহ হতে পারে।’
তবে এ মতের সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘বড় দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থান মুখোমুখি মনে হলেও, এটি এ দেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। এর আগেও বারবার মুখোমুখি হয়েছে সরকার ও বিরোধী দল; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দুই দলের একদফা ঘোষণার মাধ্যমে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ চলে গেলো কি না। আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থেকেও আলোচনা হতে পারে; কিন্তু সেজন্য স্পেস থাকতে হয় যেখানে আলাপ-আলোচনার সুযোগ থাকবে; কিন্তু বিএনপি একদফা ঘোষণার মাধ্যমে সেই স্পেস বা সুযোগ আর রাখেনি। তারা ২০১৪, ১৫ ও ২০১৬ সালের মতোই আচরণ করছে। তাদের ৩১ দফা এবং একদফা একই। সেটি হলো সরকারের পতন বা পদত্যাগ। আসলে বর্তমানে বিএনপির সেই দাবি বাস্তবায়নের মতো রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজমান নেই।’
তিনি বলেন, ‘সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হলে ব্যাপক জনসমর্থন বা জনগণের সংশ্লিষ্টতা থাকতে হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মী বা সমর্থক দিয়ে সরকারের পতন সম্ভব নয়। শুধুমাত্র জনগণের আন্দোলনের কারণেই ৯৬ সালে একতরফা নির্বাচনে সরকার গঠন করেও খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন; কিন্তু শেখ হাসিনার বেলায় সেটি নেই। তিনি শেষ মেয়াদে চার বছরেরও বেশি সময় পার করেছেন। তার তার পদত্যাগ দাবি অযৌক্তিক।’
বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতির্কত করেছে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘তত্ত্বাবধয়াক সরকার কোনো দিনই চিরস্থায়ী পদ্ধতি হতে পারে না। সেজন্য পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদালত সেই ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। তাই সেই ব্যবস্থা আবারও ফিরিয়ে আনার দাবি অমূলক।’
বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে সবচে সেরা কমিশন হিসেবে আখ্যায়িত করে এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘গাইবান্ধা উপনির্বাচন এবং পাঁচ সিটি নির্বাচনসহ তারা যত নির্বাচনই করেছে সব গ্রহণযোগ্য হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেশ জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্যই প্রয়োজন। সরকারের সামনেও এর কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে বাধ্য।’
বিএনপি রাজনৈতিকভাবে প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তাদের এক দফা বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নির্বাচনে না গেলে তারা আরও জনবিচ্ছিন্ন হবে। না হলে তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। জনগণের সমর্থন পেলে তারা সরকার গঠন করবে না হলে বিরোধী দলে থাকবে। নির্বাচনে আসা ছা্ড়া তাদের আর ভালো কোনো বিকল্প নেই।’
এ মতের সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, ‘বিরোধী দলের পূর্বনির্ধারিত একটি কর্মসূচির দিন হুট করে শান্তি সমাবেশের নামে সরকারি দলের কর্মসূচি পালন করা প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ সফররত বিদেশি প্রতিনিধিদলের সামনে এবার হয়তো তারা অতীতের মতো পরিবহন বন্ধ করে দিতে পারেনি। তবে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতাসীনরা সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। যদিও সংঘাত নিরসনে ক্ষমতাসীনদের দায়িত্বই বেশি। নাগরিক সমাজ মনে করে আগামীতে জনমতকে সম্মান করে তারা যেন সংঘাতের কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত থাকে।’
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রক্রিয়া যত বেশি দেরি হবে সংকট তত বেশ ঘনীভূত হবে এমন আশঙ্কা করে এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা যদি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চায় তবে তা হবে আত্মঘাতী। সেটি দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মোটেও সুখকর হবে না। জনগণ আশা করে, দুই দল একদফার ব্যাপারে অটল থাকলেও সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথ বের হবে। আর এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদেরই সংলাপ উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা আশা করব, বিরোধী দল তাদের সংযত কর্মসূচি পালন এবং ক্ষমতাসীনরা সংলাপ আয়োজনের মাধ্যমে সংকট দূর করবে।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘আগাম জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে প্রতিনিধিরা আসছেন এবং যাচ্ছেন। সেজন্য সরকারও রাজপথের বিরোধী দলকে স্পেস দিয়েছে। দীর্ঘদিন পর বড় দুদল রাজপথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে। এটি আশার কথা। তবে দুদলই একদফা ঘোষণা করেছে। একটি দল বলেছে, সরকারের পদত্যাগ ছাড়া নির্বাচন হবে না এবং আরেকটি বলেছে, এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। দুদলের পরস্পরবিরোধী এমন অবস্থান আপাতত পয়েন্ট অব নো রিটার্নের মতো মনে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি আরও পরিবর্তন হতে পারে। এ মুহূর্তে দুই দল আন্দোলনে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কেন্দ্র করে সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আর সেটি কখন হবে, তা সময়ই বলে দেবে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।’
মন্তব্য করুন