শেখ হারুন
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ০১:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিতরণ, অনিয়ম কেনাকাটায়

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিতরণ, অনিয়ম কেনাকাটায়

পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ওষুধ কিনছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। এতে বাড়ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের মজুত। পরে সেসব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধই যাচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীদের হাতে, যাকে বিষের সঙ্গে তুলনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে টেস্ট রিপোর্ট পাওয়ার আগেই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী গ্রহণ ও বিতরণ করা হচ্ছে এই পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে। যা সেবা নিতে আসা রোগীদের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

সম্প্রতি ফ্যামিলি প্ল্যানিং-ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারি (এফপি-এফএসডি) অপারেশনাল প্ল্যান শীর্ষক প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে এই পরিবীক্ষণ করা হয়। ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় জানা গেছে, বিপুল মজুত থাকার পরেও ১ কোটি ৪০ লাখ অতিরিক্ত ইনজেক্টেবল আইটেম ক্রয় করা হয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৩০ লাখ ৬৫ হাজার ইনজেক্টেবল ব্যবহারের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের কাছ থেকে ৫৬ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ মানেই বিষ। এগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে, কোনোভাবেই বিতরণ বা ব্যবহার করা যাবে না। এসব ওষুধ ব্যবহারে সন্তান জন্মদানে সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিতরণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালবেলাকে বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারে অনেক সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে অনিয়মিত মাসিক, জননেন্দ্রিয়ের বিভিন্ন ক্ষতি ও সন্তান জন্মদানে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিল সমস্যাও তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত ওষুধ কেনার পেছনে অবশ্যই অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। যারা কেনাকাটা ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিতরণে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এগুলো নিয়ে আপসের সুযোগ নেই।

গত নভেম্বরের স্টক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১ কোটি ৮০ লাখের বেশি ইনজেক্টেবল আইটেম মজুত রয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের মাসিক লজিস্টিক রিপোর্ট অনুসারে পূর্ববর্তী ছয় মাসে গড়ে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৫০৬ পিস ইনজেক্টেবল আইটেম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুসারে যার মেয়াদকাল উৎপাদনের তারিখ থেকে ৩ বছর। এ ছাড়া ২ বছরের জন্য মজুত থাকা সত্ত্বেও ২ কোটি ৯৭ লাখ ৬ হাজার সাইকেল খাবার বড়ি বা কনট্রাসেপটিভ ওরাল পিল (সিওপি) ক্রয় করা হয়েছে। অতিরিক্ত কেনার ফলে ৮ লাখ ৭৩ হাজার সাইকেল খাবার বড়ি ব্যবহারের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। ১৪৮ কোটি ৪০ লাখ টাকায় টেকনো ড্রাগ লিমিটেড, রেনেটা লিমিটেড এবং পপুলার ফার্মা লিমিটেডের কাছ থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) তথ্য অনুসারে খাবার বড়ির মেয়াদকাল ২ বছর। চলতি বছরের মার্চের স্টক রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সরবরাহ করার মতো ৫ কোটি ৪১ লাখ ২ হাজার সাইকেল খাবার বড়ি মজুত আছে। গত ৩ বছরে মাসিক বড়ি ব্যবহারের হার ছিল ৬১ লাখ ১০ হাজার ২৬৮টি।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ক্রয় ও বিতরণে যথেষ্ট অসংগতি দেখা গেছে। ক্রয়ের ক্ষেত্রে আরপিওর বিধান লঙ্ঘন, চাহিদা নিরূপণ না করে অতিরিক্ত সামগ্রী ক্রয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ সহায়তার অপচয় হয়েছে। এ ছাড়া টেস্ট রিপোর্ট পাওয়ার আগে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী গ্রহণ ও বিতরণের ক্ষেত্রেও পিপিএ-২০০৬ ও পিপিআর-২০০৮-এর বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে।

এদিকে অপারেশনাল প্ল্যান কার্যক্রমে ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৫ বছরে মোট ২৬৮ কোটি ৮৩ লাখ ৯ হাজার টাকার ২৭টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে, যার বেশিরভাগ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সংগ্রহ ক্রয় কার্যক্রম নিয়ে। ২৭টির মধ্যে মাত্র ৭টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে।

এ ছাড়া কেন্দ্রগুলোতে ড্রাগস এবং ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (ডিডিএস) কিটের মাধ্যমে যেসব সামগ্রী সরবরাহ করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। কখনো কখনো ডিডিএস কিটের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ফলে গুণগত মানসম্পন্ন সেবা ব্যাহত হয়।

সরেজমিন কিছু ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিতরণ করার প্রমাণও পেয়েছে আইএমইডির প্রতিনিধিদল। প্রতিবেদনে নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলা তিলনা ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের পাশাপাশি ডেলিভারি রুমটি ধুলাবালিতে ভরপুর এবং নোংরা। সেবাগ্রহীতাদের অনেকে জানান, এই কেন্দ্র থেকে সচরাচর ওষুধ দেওয়া হয় না। এমনকি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে উৎসাহিত করেন।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জনবলের অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রুমগুলো নোংরা, দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। এ ছাড়া অনেক ভবন পুরোনো হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দেয়াল ও ছাদের প্লাস্টার ঝরে পড়ছে। যন্ত্রপাতিগুলোতেও রক্ত লেগে থাকে, টয়লেটগুলো অপরিষ্কারসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা জানান, চাহিদা অনুযায়ী যেসব ওষুধ সরবরাহ করা হয়, সেগুলো স্বল্পমেয়াদের হয়। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিতরণ করে স্বাস্থ্য কর্মীদের সেবাগ্রহীতাদের কাছে নাজেহাল হতে হয়।

এ বিষয়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং-ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারির লাইন ডিরেক্টর মো. সোহেল পারভেজ কালবেলাকে জানান, তিনি দায়িত্বে নতুন হওয়ায় সব বিষয়ে এখনো ভালো জানেন না। তবে তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পরে যতটুকু জেনেছেন, সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। কেনাকাটা নিয়ম মেনেই হয়েছে। অডিট আপত্তির বিষয়ে তিনি জানান, অনেক আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকিগুলোর জবাব দেওয়া হয়েছে।

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিতরণের বিষয়ে সোহেল পারভেজ বলেন, এটা হওয়ার কথা না। যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়, সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়। তবে দু-এক জায়গায় বিতরণ করা হলেও সেটা হয়তো ভুল করে করা হয়েছে।

এদিকে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে অসুস্থ হওয়ার নজিরও রয়েছে। আইএমইডির সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনে কেস স্ট্যাডি হিসেবে দুজন নারীর ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, শেরপুর জেলার শ্রীবদী উপজেলার তাঁতীহাট ইউনিয়নের দিলারা বেগম এবং সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সড়কের বাজার ইউনিয়নের তাইবা খাতুন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগছেন। ইনজেকশন এবং ইমপ্লান্ট ব্যবহার করে তাদের দুজনেরই অনিয়মিত মাসিকসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় উদ্যোগে ফ্যামিলি প্ল্যানিং ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারি অপারেশনাল প্ল্যানটি গ্রহণ করা হয়। ২ হাজার ২৬২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। কয়েকবার সংশোধনের ফলে ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ হাজার ৪২৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অগ্রগতি ৬৩ শতাংশ। দুর্গম এলাকা এবং শহরের বস্তি এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা সেবা কার্যক্রম জোরদার করা, স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবাদান কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা, কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং মানসম্মত সেবা প্রদান করা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়লেন বিসিএস ক্যাডারের ৬ কর্মকর্তা

চাকরি দিচ্ছে এসিআই, আবেদন করুন এখনই

কালুখালী জংশনে থামবে বেনাপোল এক্সপ্রেস, স্থানীয়রা উচ্ছ্বসিত 

হচ্ছে না ‘রাউডি রাঠোর ২’

নিজের বিয়ে নিয়ে বিভ্রান্তি কাটালেন তানজিদ তামিম

টেলিকম প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে গোয়েন্দা নজরদারির গোমর ফাঁস

‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামের উন্নয়নে কাজ করবে বাফুফে’

সাদাপাথর লুটপাটে জড়িতের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা হবে : সিলেটের ডিসি 

প্রধান উপদেষ্টাকে উপহার দিলেন মেঘ

মোটরযানমুক্ত আধুনিক শহর, দেখেই চোখ জুড়ায় (ভিডিও)

১০

জিলানীর শরীরে রয়ে যাওয়া ‘পিলেট’ অপসারণ করলেন বিএনপির স্বাস্থ্য সম্পাদক রফিক

১১

গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে : আখতার 

১২

৫ কাজ করতে পারবেন না ডাকসুর প্রার্থীরা

১৩

ধেয়ে আসছে অতি ভারী বৃষ্টিবলয় ‘স্পিড’, কবে কোথায় প্রভাব ফেলবে

১৪

এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিল ভারত সরকার

১৫

ইমিগ্রেশনের সময় যে ৭ কথা বললেই মহাবিপদ

১৬

সাগর-রুনির সন্তান মেঘের হাতে পূর্বাচলের প্লটের দলিল হস্তান্তর

১৭

৮ মামলায় ইমরান খানের জামিন

১৮

মাদ্রাসাপ্রধানদের জন্য অধিদপ্তরের জরুরি নির্দেশনা, না মানলে ব্যবস্থা

১৯

বরাদ্দ পেল বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

২০
X