নির্বাচন ঘিরে বেফাঁস ও বিতর্কিত মন্তব্য যেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পিছু ছাড়ছে না। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন কেন্দ্র করে চরম সমন্বয়হীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূলের নেতাদের বেফাঁস মন্তব্যে বিব্রত নীতিনির্ধারকরা। এক উপজেলায় বিতর্কিত মন্তব্যের রেশ না কাটতেই অন্য উপজেলায় একই ধরনের ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতৃস্থানীয়রা। ধারাবাহিক এসব কর্মকাণ্ডে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে দলের।
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে উপজেলা পরিষদের তিনটি ধাপের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ। নিজ নিজ প্রার্থীকে জেতাতে প্রচারণা এখন তুঙ্গে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের পক্ষে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বিভক্ত হয়ে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। আর এই প্রচারে অংশ নিয়ে একে অপরের চরিত্রহনন ও কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। একই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে বেফাঁস মন্তব্যের হিড়িক পড়েছে। উপজেলা নির্বাচনকেন্দ্রিক এসব বিতর্কিত মন্তব্য তৃণমূল সংগঠনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি বিব্রত হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। দলের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে উপজেলা নির্বাচন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং নির্বাচন শেষে এর মূল্যায়ন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে নীতিনির্ধারকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, ‘তৃণমূলের নেতাদের এসব মন্তব্যে দল কিছুটা বিব্রত হয় বটে; তবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার শাস্তি পেতেই হবে। এদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের হুমকি-ধমকিতে প্রভাব পড়ছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অন্য প্রার্থী ও ভোটারদের ওপর। প্রথম ধাপের নির্বাচনে মাত্র ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পড়ায় ক্ষমতাসীন দল কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন। উপজেলা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার যে চেষ্টা, তা চেয়ারম্যান প্রার্থীদের হুমকি-ধমকিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন অনেকে অংশ নেওয়ায় একজন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অনেক প্রার্থীর অভিযোগ, এভাবে হুমকি চলমান থাকলে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক প্রার্থীর।
জানা গেছে, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১০ আসনের এমপি আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই গোলাম সারওয়ার। প্রার্থী ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার ও নানাভাবে হুমকির অভিযোগ তুলেছেন সদর আসনের এমপি ও নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বিরুদ্ধে। বাহারের কড়া সমালোচনা করে দেওয়া বক্তব্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী ও সদর দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম সারওয়ার গত মঙ্গলবার রাতে এক নির্বাচনী পথসভায় বলেন, ‘হুমকি দেবেন, আমরা কি বসে বসে আঙুল চুষব নাকি? উপরের নির্দেশ আছে—পিটাইয়া লম্বা করে দাও।’
যারা তাদের সহযোগিতা করে, আগে তাদের পিটিয়ে লম্বা করার আহ্বান জানিয়ে সারওয়ার তার নেতাকর্মীর উদ্দেশে বলেন, ‘একদম সোজা করে পিটান। এটা আমাদের বহু উপরের নির্দেশ। তোমরা পিটাচ্ছ না কেন? হুকুম দেওয়া লাগবে? আপনারা যার যা আছে, তা নিয়ে প্রস্তুত হন। সাড়ে তিন হাইত্যা লাঠি, আড়াই হাইত্যা লাঠির চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র অইতে পারে না। এডা আরম্ভ করেন; দেখবেন, সব দালালের দালালি বন্ধ হয়ে যাবে। সব সোজা হয়ে যাবে।’
সারওয়ারের এসব হুমকির বিরুদ্ধে অন্য চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল হাই বাবলু বিধি অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে বরিশালের বানারীপাড়ায় নিজেকে এলাকার সবচেয়ে বড় গুন্ডা বলে দাবি করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক। এ নির্বাচনী কর্মিসভায় তিনি বলেন, ‘আমার চেয়ে বড় মাস্তান, বড় গুন্ডা বানারীপাড়ায় নাই।’ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে নির্বাচন কমিশন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
অন্যদিকে ভোটের পর ফল পরিবর্তিত হয়ে যায় বলে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী কামরুল হাসান খোকন। তিনি বলেন, ‘ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা নেই, বিশ্বাস উঠে গেছে। সারা দিন দুই থেকে তিনটা করে ভোট পড়েছে। বিকেলে তা বানানো হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩ হাজার।’
নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দিলে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। তার সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী গোলাম শরীফ চৌধুরী পিপুলের সমর্থনে আয়োজিত কর্মী সভায় বলেন, ‘আমার কথা সোজাসুজি। আমি বাঁকা কথা আমি বলি না। পরে ভেজাল হয়ে যাবে। কী বলছি বুঝেছেন তো? এমনি ভালো আছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়েছে? আপনারা শান্তিতে আছেন। ভোট যদি আমাদের তিনজনকে (চেয়ারম্যান, পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান) দেন, তাহলে কেন্দ্রে আসিয়েন। না হয় পরে ঝামেলা হলে আমি দায়িত্ব নিতে পারব না। শুধু শুধু কষ্ট করে কেন্দ্রে আসবেন না। বাড়িতে ঘুমাইয়েন। তাহলে পরে নিরাপদে বাকি পাঁচটা বছর থাকতে পারবেন।’
উপজেলা নির্বাচনে বেফাঁস মন্তব্যে পিছিয়ে নেই ছাত্রলীগের নেতারাও। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারী প্রতিপক্ষ প্রার্থীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘…নানান বক্তৃতায় হুমকি দিচ্ছেন। আপনার এই হুমকি কোনো কাজে আসবে না। ...কোনো সন্ত্রাসী কোনো কাজে আসবে না। ছাত্রলীগের ওপরে কোনো সন্ত্রাস নাই, কোনো শক্তি নাই।’ চেয়ারম্যান প্রার্থী ও শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিস ফরাজীর নির্বাচনী সভায় তিনি এই হুমকি দেন।
অন্যদিকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মংমনসিংহ-৪ (সদর) আসনের ফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম এ কুদ্দুস। গত ১১ মে উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে একটি মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘আপনারা গত নির্বাচনে ট্রাক মার্কাকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন। আমিনুল হক শামীম ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু বিকেলে অদৃশ্য হাতের ইশারায় তাকে ফেল করানো হয়েছে। ১ লাখ ৩ হাজার ভোট, এটি বাড়ির কাছের কথা নয়। ৫০ হাজার ভোট এদিক-সেদিক করে ফেলছে, না হলে এই ভদ্রলোক (আমিনুল হক শামীম) পাস করেন।’
তার এমন বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন ওই নির্বাচনে বিজয়ী নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত। ফেসবুকে দেওয়া এক বার্তায় তিনি সংসদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান।
এদিকে এসব বেফাঁস মন্তব্য করায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ৪ নম্বর ধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের মো. জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত মিরসরাই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমানের ঘোড়া প্রতীকের সমর্থনে আয়োজিত সমাবেশে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বলেন, ‘গত ৭ জানুয়ারি শেষ হওয়া সংসদ নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রিয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সুযোগ্য সন্তান মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি। আগামী ৮ মে শেষ হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোনো অপকর্ম ছাড়া ভোটকেন্দ্র খোলা রাখব।’
এ বিষয়ে উপজেলা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বলেন, ‘গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একটি অনুষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যের জন্য কেন্দ্র থেকে ১৫ দিনের মধ্যে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। আমি শিগগির নোটিশের জবাব দেব।’
সার্বিক বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালবেলাকে বলেন, ‘বেফাঁস, অপ্রয়োজনীয় ও অতিকথন বন্ধ হওয়া দরকার। এসব অতিকথন সমস্যা ও বিরক্তির সৃষ্টি করে। দলের জনপ্রিয়তা কমায়। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার একই সঙ্গে কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন দলের কেন্দ্র থেকে নিচ পর্যন্ত।’