হাসান আজাদ
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৪, ০৩:৩৩ এএম
আপডেট : ২১ মে ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডলার সংকটের মধ্যেই ৬ রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে

উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

মার্কিন ডলারের তীব্র সংকটের কারণে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। পাশাপাশি একই সংকটের জন্য চাহিদা অনুযায়ী প্রাথমিক জ্বালানিও (গ্যাস, তেল ও কয়লা) আমদানি করতে পারছে না। এমনকি সরকার কাতার থেকে বাকিতে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আনার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া পড়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় সরকার আবারও উচ্চ দামের ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ছয়টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি খরচ হয় ১৬ থেকে ১৮ টাকা। মেয়াদ বাড়ানোর কারণ সম্পর্কে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখতে কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি চলমান সেচ মৌসুম ও গ্রীষ্ম মৌসুমের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন আছে।

তবে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফার্নেস অয়েলনির্ভর রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মেয়াদ

বাড়ানোর জন্য ফ্রিকোয়েন্সির যে কথা বলা হচ্ছে, তা একেবারেই ঠিক নয়। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট আসার আগে তো গ্রিড ছিল এবং ফ্রিকোয়েন্সিও ছিল। তারা বলেন, সরকার সমর্থিত লোকজনকে ব্যবসা দেওয়ার জন্যই এসব রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এর বিল কীভাবে পরিশোধ করবে সরকার। এ ছাড়া এ নিয়ে যাতে কোনো কিছু বলা না যায়, সেজন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনে কাজটি করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, যে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে, সেগুলোকে আমরা পকেট প্লান্ট বলি। গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখতে এসব কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। যে অঞ্চলে অবস্থিত, কেন্দ্রগুলো থেকে সেই এলাকাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

এদিকে, সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ছয়টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।

এই ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো—সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেডের মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট, ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেডের মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট ও খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট এবং একর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সার্ভিসেস লিমিটেডের জুলদা ১০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে মদনগঞ্জ কেন্দ্রের মেয়াদ গত ২২ মার্চ শেষ হয়েছে। মেঘনাঘাট, সিদ্ধিরগঞ্জ, নোয়াপাড়া, খুলনা কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৩ মার্চ এবং জুলদা কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল।

এ প্রসঙ্গে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘যারা বলছে ফ্রিকোয়েন্সির জন্য ফার্নেস অয়েলনির্ভর রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে, তারা জনগণকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে। অথবা তারা মূর্খ। যখন রেন্টাল ছিল না তখন কি আমাদের গ্রিড চলেনি, চলেছে। কোনো সমস্যা হয়নি। প্রকৃত অর্থে মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা দেওয়ার জন্য। বিশেষ আইনে এসবের মেয়াদ আগেও বাড়ানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে।’

একই কথা বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, ফ্রিকোয়েন্সির জন্য উচ্চ দামের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হবে, এটা আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এ ছাড়া এত দামের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পিডিবি বিদ্যুৎ কিনবে, টাকা দেবে কোথা থেকে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের মাত্র ৩ শতাংশ বিদ্যুৎ জ্বালানি তেলে উৎপাদিত হয়। আর আমাদের দেশে হয় ৩০ শতাংশ। আমার জানা মতে, ভারতের গ্রিডে কোনো তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিবের পাঠানো সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বৃহৎ আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্রমান্বয়ে অবসর দেওয়া হচ্ছে। ডিজেলভিত্তিক মোট ১৪০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক মোট ৩৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি এবং গ্যাসভিত্তিক মোট ৬১৩ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটিসহ সর্বমোট ২৩৯৮ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৪টি আইপিপি রেন্টাল/কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অবসর দেওয়া হয়েছে। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রক্ষা, রিলায়বিলিটি বৃদ্ধি এবং ট্যারিফ তুলনামূলক কম হওয়ায় কিছু কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৭৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯টি এবং গ্যাসভিত্তিক ৫৫৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট। জ্বালানির সীমাবদ্ধতার কারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ক্ষমতায় চালানোর ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গ্যাসের অপ্রতুলতার এ বাস্তবতা বিবেচনায় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ জরুরিভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখতে সহায়ক হবে। ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট, মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ঢাকা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এরই মধ্যে অবসর দেওয়া হয়েছে বিধায় ঢাকা অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলা ও সিস্টেম রিলায়বিলিটি রক্ষার স্বার্থে এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত না থাকায় গ্রিড সচল রাখা, তাৎক্ষণিক বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলা ও লোডশেডিং এড়ানোর লক্ষ্যে নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট, খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে জুলদা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের হালিশহর ও শিকলবাহায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি চলমান সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা অত্যধিক বেড়েছে। সে বিবেচনায় গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলায় এ ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বড় ধাক্কার সামনে লিভারপুল

মেটা কি ফোনের মাইক্রোফোন দিয়ে আপনার কথা শোনে? যা বলছেন ইনস্টাগ্রাম প্রধান

তারা যে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সেটা দারুণ ব্যাপার: সাকিব

সপ্তাহের সেরা চাকরির বিজ্ঞপ্তি, পদ সংখ্যা ৯৬৩

ফুটবলে প্রথমবার দেখা গেল ‘গ্রিন কার্ড’, কীভাবে কাজ করবে?

ডাম্প ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত

‘আকাশে মেঘ দেখলেই সবজির দাম বাড়ে’

রাজধানীতে বাস থামিয়ে গুলি, এরপর দিল আগুন

ইসলামী ব্যাংকের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ হ্যাকড

অফসাইড-হ্যান্ডবলের বিতর্ক মেটাতে আসছে বিশ্বকাপ বল ‘ট্রায়োন্ডা’

১০

দোয়ার সময় এই মারাত্মক ভুল করছেন না তো? জেনে নিন

১১

ভেনেজুয়েলার উপকূলের পাঁচটি মার্কিন যুদ্ধবিমান

১২

বুক দিয়ে ঘানি টেনে সংসার চালান ষাটোর্ধ্ব দম্পতি

১৩

বাংলাদেশের কাছে হারের মূল কারণ জানালেন রশিদ খান

১৪

সুমুদ ফ্লোটিলা আটকের ঘটনায় বাংলাদেশের নিন্দা

১৫

‘রাজনৈতিক সংকট সমাধান ফিফার কাজ নয়’

১৬

ইতিহাসের প্রথম জুমার জামাতে কতজন মুসল্লি ছিলেন?

১৭

সুরা পড়ে মারুফার জন্য দোয়া করেন মা

১৮

খুব অল্প সময়ে সৃজিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছি: সুস্মিতা

১৯

হারামাইনে আজ জুমা পড়াবেন যারা

২০
X