দেশে রাজস্ব ব্যবস্থার প্রসার না ঘটলে সরকারের আয় বাড়ানোর সুযোগ কম। একইভাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার এবং চলতি বাজারমূল্যে জিডিপির আকার বাড়ানো না গেলে ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিতে সেই সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব উদ্যোগেও আসবে না গতি। এই বাস্তবতায় প্রতিবছরই বাজেটীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ জিডিপি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, ভোগ ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, সঞ্চয় এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ রাখতে দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক প্রায় বছরই বাস্তবায়ন পর্যায়ে এর প্রতিফলন ঘটছে না, এমনকি বাজেটে রাজস্ব নীতির অভীষ্ট অর্জনসহ বাজেটীয় বেশিরভাগ সূচকের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হচ্ছে না।
অন্যদিকে বাজেটে নেওয়া সরকারের বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জন তথা আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাজেট-পরবর্তী সহায়ক মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে নেপথ্যে কাজ করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের। সেই অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার এবং লেনদেনের ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা, নিরাপদ স্তরে রিজার্ভ ধরে রাখা, বিনিয়োগ সহায়ক নীতি সুদহার ধার্য, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় ঋণের সীমা নির্ধারণে কার্যকর মুদ্রানীতি প্রয়োগ হওয়ার কথা। একইভাবে বাজেটীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারকে প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান নিশ্চিত, আমদানি-রপ্তানি সচল, অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ এবং বৈধপথে প্রবাসী আয় দেশে আনার কাজও বাংলাদেশ ব্যাংকের। বিগত সময়ে বাজেট সহায়ক এই মুদ্রানীতিই ছিল সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটে ঘোষিত রাজস্ব নীতির মেলবন্ধন বা সমন্বয় তৈরি হচ্ছে না। বরং অনেক পদক্ষেপ সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে।
এর ফলে বাজেটে নেওয়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, জিডিপির আকার, বিনিয়োগ জিডিপি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, ভোগ ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, সঞ্চয় এবং সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্থিক খাতকে ঠিক রাখতে স্বয়ংসম্পূর্ণ মুদ্রানীতি প্রয়োগ করতে পারছে না।
দেশে রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির এই যখন বাস্তবতা তখন ফের আরও একটি বাজেট আসন্ন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটি হবে সংকোচনমুখী। তবে এর ভেতরেই চলমান সংকট উত্তরণের অনেক নির্দেশনা থাকবে। সেই অনুযায়ী বাজেট-পরবর্তী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত মুদ্রানীতিটিও এবার সংকোচনমুখী হবে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বাজেটের রাজস্ব নীতি হবে বেশ সম্প্রসারণমূলক। এর মাধ্যমে কর আদায়ের চেষ্টা থাকবে বেশি। কিন্তু মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক হলে এই ব্যবস্থায় সৃষ্ট অর্থনীতি থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পাওয়ার লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মতো লক্ষ্যচ্যুতই থেকে যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ এই দুই নীতি পদক্ষেপের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে তার মূল্য অর্থনীতিকেই দিতে হবে। বর্তমানে অর্থনীতিতে যে সংকট, এটি তারই খেসারত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএসএর সাবেক মহাপরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্ত কালবেলাকে জানান, সাধারণত বাজেট যদি সংকোচনমূলক হয়, মুদ্রানীতিও সংকোচনমূলক হবে। তবে বাজেটে যে রাজস্বনীতির লক্ষ্য থাকে সেটি দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া—যার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন কোনো এক বছরে সম্ভব নাও হতে পারে। এর বিপরীতে মুদ্রানীতি হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের উদ্যোগ, যার মাধ্যমে ওই সময়ের অর্থনীতিকে ভারসাম্য রক্ষার জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে হয়। এরই মধ্যে যতটা সম্ভব বাজেট সহায়ক পদক্ষেপকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে অর্থনীতির এমন কিছু পদক্ষেপ থাকে, যার সব লক্ষ্য একসঙ্গে অর্জন কঠিন। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতিকেই মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে অনেক সময় কিছু লক্ষ্যমাত্রায় গ্যাপ থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে আর্থিক নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, গত এক বছরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এটা আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ হারে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে আগামী অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা বাড়ানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই বাড়তি উৎপাদন অর্থনীতি থেকে সরকার আসন্ন বাজেটে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা করছে, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেশি।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এর জন্য বিনিয়োগ সহায়ক অনুকূল পরিবেশ দিতে হবে। বাজেটে এই অনুকূল পরিবেশ তৈরির প্রতিশ্রুতি থাকে, কিন্তু সেটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হয়। কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। চলতি অর্থবছর এর গড় প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উৎপাদন ও সেবার সরবরাহে মন্দা তৈরি করেছে। এতে অনেক সক্ষম করদাতাও কর দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এই পরিস্থিতিতেও যত দূর ধারণা করা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে। সে ক্ষেত্রে বাজার থেকে যতটা সম্ভব টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে মুদ্রানীতিতে। এজন্য নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরও বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির খুব একটা উন্নতি হবে না। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তার ব্যয়ের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, ফলে মানুষের ভোগব্যয় কমে গেছে। বড় আতঙ্ক রিজার্ভ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী আয় প্রত্যাশিত হারে আসছে না। ডলারের অপর্যাপ্ততা এবং দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও আর্থিক খাতের দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানিকারকদের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাস্তবতায় জিডিপির আকার এত বেশি বাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন না তারা। একইভাবে এক বছরের ব্যবধানে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশের ঘরে থাকা মূল্যস্ফীতিকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আবার এর জন্য দেশ যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির শিকার হবে, তার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিকে ক্রমশ সংকটের দিকেই ধাবিত করবে।
বাজেট পদক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগামী বাজেটে ঘাটতি ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশের বিপরীতে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যে হাঁটছে সরকার। এর মধ্যে মোট বিদেশি ঋণ ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। যেখানে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই নেওয়া হতে পারে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই বাস্তবতায় সরকারের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো মূল্য স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। যেখানে সরকার মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায়, সেখানে যদি বর্ধিত সুদে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এই বিপুল অঙ্কের ঋণ নেয়, সেটির জোগান দিতে ফের বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপানোর পথে হাঁটে, তা হলে মূল্যস্ফীতি কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। একইভাবে বেসরকারি খাতে ঋণের সরবরাহ চেপে ধরা হলে দেশে উৎপাদন, কর্মসংস্থান কম হবে। ফলে সেটি দেশের সামগ্রিক ভোগব্যয়কেও কমিয়ে দেবে। পাশাপাশি বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতার বাড়তি খরচ হবে। এতে তারা সঞ্চয় কমিয়ে দেবে। অন্যদিকে ঋণ ও সঞ্চয় কমে গেলে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। সেটি মোট দেশজ উৎপাদন কমিয়ে দেবে, যা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকে ব্যাহত করবে।
অন্যদিকে, প্রবাসীদের আয় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। এটি মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এর পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং সঞ্চয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সরকার বাজেটে প্রবাস আয় বাড়াতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর নীতি পদ্ধতির অভাবে তার সুফল মিলছে না। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্বলতম ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না হওয়ায় হুন্ডি প্রক্রিয়া আগের চেয়ে আরও জোরদার হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ার ভেতরে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো অভিনব উপায়ে দেশ থেকে মূল্যবান অর্থ ডলারে রূপান্তর করে বিদেশে পাচার প্রবণতা বাড়ছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বা রিজার্ভকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতির উন্নয়নে এসব ক্ষেত্রেও দক্ষতা ও মুদ্রানীতির কার্যকর প্রয়োগ ঘটে না।