মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৪, ০২:৫১ এএম
আপডেট : ০৪ জুন ২০২৪, ০৭:৪০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুখে কঠোর বাস্তবে ছাড়

খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে, তার অন্যতম শর্ত হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা। বিশেষ করে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। সম্প্রতি ঋণখেলাপিদের ধরতে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো পদক্ষেপেই অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ খেলাপি ঋণকে আর্থিক খাতের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখলেও ঋণখেলাপিদের একের পর এক ছাড় দেওয়ার নীতি নিয়েছে। সর্বশেষ গত এপ্রিলেও ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে জারি করা সার্কুলার অনুযায়ী, কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। আগে এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। গত বছরের জুলাই মাসে ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবর্তন এনে ঋণখেলাপি গ্রাহকদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

এর আগে বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার

এক সপ্তাহের মধ্যে ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দিয়ে মাস্টার সার্কুলার জারি করা হয়। এতে ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ঋণ পুনঃতপশিলের গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ সময়সীমা যেমন বাড়ানো হয়, তেমনি ন্যূনতম পরিশোধের (ডাউনপেমেন্ট) হার কমিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, নতুন নীতিমালায় তিনবারের পরিবর্তে চারবার ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ রাখা হয়।

ওই সার্কুলারে বলা হয়, খেলাপি ঋণ আদায়ের স্বার্থে বিশেষ বিবেচনায় চতুর্থবার পুনঃতপশিল করা যাবে। শুধু তাই নয়, সেখানে ঋণ পুনঃতপশিল এবং পুনর্গঠনের দায়িত্ব ব্যাংকের পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা আগে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করত।

তারও আগে করোনা মহামারির সময় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধ এবং খেলাপি ঘোষণার ক্ষেত্রে দফায় দফায় নানা ধরনের ছাড় দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব ছাড়ের সুযোগ নিয়ে লাগামহীনভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে, যা ২০২২-এর মার্চের তুলনায় ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে গত দুই বছরে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের। ২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দুই বছরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৩১ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের ১২১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো চলতি বছরের প্রথম (জানুয়ারি-মার্চ) প্রান্তিকের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। তবে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানেই খেলাপি ঋণের এই চিত্র উঠে এসেছে।

আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উদ্দেশ্যে রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মন্দ ঋণ পরিস্থিতি এর উল্টো পথে হাঁটছে। এক বছরে খেলাপি ঋণের হার ২৭ শতাংশ বেড়েছে। শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছেই আটকে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ৩০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। গুটিকয়েক গ্রাহকের কাছে ঋণের বড় অংশ আটকে থাকায় ব্যাংকের ঋণঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, বাজারভিত্তিক করার কারণে ঋণের সুদহার আরও বাড়বে। ফলে আগামীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ১৮ হাজার ১৭১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। আগের দুই বছরের মার্চে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও এর প্রায় সমান। অবলোপন করা এই ঋণকে যুক্ত করা হলে মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে দিন দিন এই অঙ্ক বাড়লেও খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় বাড়ছে না। প্রতি বছর ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ আদায়ের হার ব্যাংকগুলোর এক বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং মোট খেলাপি ঋণের শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমি ঋণখেলাপিদের ধরতে চাই, ঋণখেলাপিদের ধরতে হবে।’

তারা তো খুব শক্তিশালী, ধরতে পারবেন কি না—এমন প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘দেখি পারি কি না।’

তবে ঋণখেলাপিদের ধরতে সরকারের সদিচ্ছা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, মুখের কথায় আর কাজ হবে না। কার্যকর পদক্ষেপের সেটা প্রমাণ করতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আমি খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছি না। কারণ যারা ঋণখেলাপি তারা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, হয় সংসদ সদস্য বা তাদের আত্মীয়স্বজন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে যে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এটা আমার মনে হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আইএমএফের শর্তের জন্যই নয়, ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ভালো করতে অবশ্যই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা দরকার। সেজন্য যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়, তাহলে খেলাপিদের ধরা খুব বেশি কঠিন হবে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘শুধু অর্থমন্ত্রী মুখে বললেই খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ বিষয়ে সরকারের এজেন্ডা থাকতে হবে। যেটা একেবারেই দেখা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা যদি থাকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলেই খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বলে দেয়, খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারলে পারফরম্যান্স নেতিবাচক ধরে সব রকম সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে, তাহলেই খেলাপি ঋণ আদায় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দেওয়া, সময় বাড়িয়ে দেওয়া, সহজ শর্তে পুনঃতপশিল করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে অর্থমন্ত্রীর কথার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে বৈপরীত্যে দেখা যাচ্ছে। তার মানেই হচ্ছে আইএমএফের চাপে পড়ে অর্থমন্ত্রী রাজনৈতিক জায়গা থেকেই এমন বক্তব্য দিয়েছেন। সেটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে আন্তরিক সদিচ্ছা লাগবে এবং সেই আলোকে কিছু আইন প্রয়োগ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আইএমএফের চাপে নয়, দেশের স্বার্থে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘সাবেক অর্থমন্ত্রীর সময়ে আমরা দেখেছি, খেলাপি ঋণকে নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। মাত্র ২ শতাংশ পরিশোধ করলে খেলাপির তালিকা থেকেই নাম মুছে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন নতুন অর্থমন্ত্রী কী ব্যবস্থা নেন, তা দেখার অপেক্ষায় আছি। মুখের কথায় কাজ হবে না। কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে, তারা খেলাপি ঋণ কমাতে এবং খেলাপিদের ধরতে কতটা আন্তরিক?’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অন্যের চার্জার দিয়ে ফোন চার্জ, ঘটতে পারে যেসব বিপদ

সন্ধান মিলল অস্ত্র তৈরির কারখানার, আটক ২

গাজীপুরে ছাত্রদলের আনন্দ মিছিল

জবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শরিফুল কারাগারে 

২০২৬ সালে রমজান শুরুর সম্ভাব্য তারিখ প্রকাশ

সেই জিলাল হোসেনকে বরখাস্ত করল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় এবার ফিলিস্তিনি সুন্দরী

নারায়ণগঞ্জে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ২২

হোয়াইট হাউসে বৈঠক : ট্রাম্প-মাখোঁর কানাকানি নিয়ে চলছে আলোচনা

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হলেন শহীদুজ্জামান

১০

দেড় যুগেও নির্মাণ হয়নি ভেঙে ফেলা জহির রায়হান মিলনায়তন 

১১

ভারতের অন্তঃসত্ত্বা নারীকে বাংলাদেশে পুশইন, সন্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দিহান

১২

৫ আগস্টের বিজয়কে ধরে রাখার আহ্বান চট্টগ্রাম ডিসির

১৩

ব্লুটুথ হেডফোন নাকি সাধারণ হেডফোন, কোনটি ভালো জানেন?

১৪

রাকসু নির্বাচন ঘিরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ১০ দফা প্রস্তাবনা

১৫

‘ছোট সাজ্জাদের’ স্ত্রী তামান্না তিন দিনের রিমান্ডে

১৬

ফিক্সিংকাণ্ডে আলোচনায় ঢাকা ক্যাপিটালস, কী বলছে শাকিব খানের দল

১৭

জুমার নামাজে না গেলে ২ বছরের দণ্ডের বিধান করল যে দেশ

১৮

প্রিমিয়ার ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করল বাংলাদেশ ব্যাংক

১৯

সাতক্ষীরায় স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

২০
X