লোহিত সাগর ও আরব সাগরের নীল জলরাশির সমুদ্রতট ঘেঁষে অবস্থিত রাষ্ট্র সোমালিয়া। সোমালিয়া নামটি শুনলে একসময় ক্ষুধায় কঙ্কালসার মানুষের ছবি উঠে আসত সংবাদমাধ্যমে। আর এখন হর্ন অব আফ্রিকার এ দেশের নামটুকু শোনামাত্র মানসপটে ভেসে ওঠে পণ্যপরিবাহী জাহাজ লুটপাট, নাবিকদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কিংবা অতর্কিত হামলা, গোলাবর্ষণ ইত্যাদি সব দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডের ভয়ংকর চিত্রপট। সর্বশেষ ভারত মহাসাগরে এমভি আবদুল্লাহ নামে একটি বাংলাদেশি জাহাজ অপহরণের মধ্য দিয়ে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে এ জলদস্যুরা। জলদস্যুরা কীভাবে সাগরে জাহাজ অপহরণ করে, অপহরণের পর সে জাহাজকে কোথায় নিয়ে যায়, মুক্তিপণের অর্থই বা কীভাবে আদায় করে তারা আর এসবের পেছনে কারা জড়িত, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের যেন শেষ নেই। গ্রন্থনা : ওয়াহেদুজ্জামান সরকার
সোমালিয়ার জলদস্যুরা সাধারণত পণ্যবোঝাই জাহাজকে টার্গেট করে থাকে। এ ধরনের জাহাজগুলো সাধারণত ধীরে চলে আন্তর্জাতিক নৌরুটে। বেশি পণ্যবোঝাই থাকায় বেশিরভাগ জাহাজের গতি থাকে ১৮ থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল। জলদস্যুরা যখন কোনো জাহাজকে টার্গেট করে তখন তারা ছোট ছোট বোট বা নৌকায় অস্ত্র নিয়ে তিন থেকে চারদিক ঘিরে ফেলে আক্রমণ করে। তিন-চারদিক থেকে যখন আক্রমণ করে, তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। একপর্যায়ে জাহাজে উঠে তারা নাবিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে। শুরুতে জলদস্যুরা অপহৃতদের ফোনে নিজ পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিলেও পরে ফোন কেড়ে নেয়। তারপর সাগর থেকে অপহৃতদের জাহাজকে সোমালিয়ার জঙ্গলের দিকে নিয়ে আসতে থাকে। এ সময় তাদের সেই ছোট ছোট বোট বা নৌকাগুলো সাগরপথে জাহাজটিকে পাহারা দেয়। সোমালিয়ার জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে তাদের বন্দি করে রাখা হয়। এখানে আসার পরই মূলত অপহৃতদের স্বজন বা জাহাজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জলদস্যুরা যোগাযোগ শুরু করে। এ যোগাযোগের মাধ্যমে তারা বিশাল মুক্তিপণ দাবি করে থাকে। যতদিন পর্যন্ত না তারা মুক্তিপণ পেয়ে থাকে, ততদিন অপহৃতদের এ জঙ্গলেই আটকে রাখা হয়। বন্দি থাকাকালে অপহৃতদের খাবার দেওয়া হলেও তা পরিমাণে বেশ সামান্য। অনেকে ঠিকমতো খাবার না পেয়ে মারাও যায়। মুক্তিপণ যথাসময়ে না দেওয়ার কারণে সোমালিয়ার এ জঙ্গলেই হয়েছে অনেকের শেষ ঠিকানা।
প্যারাসুটের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়
রব ফায়ারে নামে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক পাইলট সেনাবাহিনী ছাড়ার পর প্রায় ১৭ বছর আফ্রিকায় বাস করেন। এ সময় তিনি খুব কাছ থেকে সোমালি জলদস্যুদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। এ ১৭ বছরে অনেক অপহরণের ঘটনায় তিনি জলদস্যু ও জাহাজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে মূল আলোচনাকারীর ভূমিকা পালন করেন। তার মাধ্যমেই ক্ষতিপূরণের অর্থের দরকষাকষি এবং তা প্রদান করা হতো। একজন সাবেক মুক্তিপণ বিতরণ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি সোমালিয়ায় অবস্থানের সময় তার এ ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বইও লেখেন। কয়েক বছর আগে পশ্চিমা এক সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে প্রায় ৩০টির মতো ঘটনায় নাবিকদের মুক্তিপণের বিনিময়ে উদ্ধার করতে সক্ষম হই আমি। সেইসঙ্গে অপহৃত জাহাজকে মালিকপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিই। মুক্তিপণের পদ্ধতি বেশ অভিনব। একটি বিশেষ ব্যবস্থায় বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে মুক্তিপণের অর্থ পানিতে ফেলা হতো। পানিতে ফেলা সেই অর্থ সংগ্রহ করে জাহাজে গিয়ে গুনে নিশ্চিত হওয়ার পর সেখান থেকে চলে যেত জলদুস্যরা। একই সময়ে অপহৃত জাহাজের কর্তৃপক্ষের লোকজন সেই জাহাজে ঢুকে তাদের নাবিক ও পণ্য বুঝে পেয়ে সেখান থেকে নিকটতম নিরাপদ বন্দরে চলে যেত। পুরো প্রক্রিয়াটিই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ অর্থ পেয়েও জাহাজ ও নাবিকদের যদি জলদস্যুরা ছেড়ে না দেয়, তাহলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতো। তবে এ ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। জলদস্যুরা দাবি করা অর্থ পাওয়ার পর তাদের কথা রেখেছে।’ রব ফায়ারের মতে, ‘যদি আমাকে মুক্তিপণের বিতরণ করা মোট অর্থের একটি পরিসংখ্যান দিতে হয়, তবে তা প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার হবে।’