বিজনেস প্রসেসিং আউটসোর্স বা বিপিও খাতের বার্ষিক বাজার এখন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার। কর্মরত প্রায় ৭০ হাজার কর্মী। বিপিও খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ে (বাক্কো) ৩২৫টিরও বেশি সদস্য প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত আছে। নতুন করে যারা বিপিও প্রতিষ্ঠান চালুর কথা ভাবছেন, তাদের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বাক্কোর সাধারণ সম্পাদক এবং ফিফোটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী তৌহিদ হোসেন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন শাওন সোলায়মান-
যেসব ডকুমেন্ট প্রয়োজন
প্রোপ্রাইটরশিপ প্রতিষ্ঠান হলে প্রথমেই লাগবে একটি ট্রেড লাইসেন্স। লিমিটেড কোম্পানি হলে প্রয়োজন হবে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ নিবন্ধকের (আরজেএসসি) কার্যালয়ের নিবন্ধন। বিপিও ও আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানে যদি ভয়েস সেবা দেওয়া হয়, তাহলে প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) অনুমতি বা লাইসেন্স। এ জন্য প্রয়োজন হবে বাক্কোর সদস্যপদ বা সদস্য হিসেবে বাক্কোতে নিবন্ধন। এ ছাড়া ভ্যাট সার্টিফিকেট, ট্যাক্স সার্টিফিকেট এবং কর রেয়াতি সুবিধা চাইলে কর মওকুফ সনদপত্র প্রয়োজন হবে।
সফটওয়্যার
সাধারণত সব প্রতিষ্ঠানেই কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট বা সিআরএম সফটওয়্যার প্রয়োজন হয়। প্রতিষ্ঠানে যদি ‘ভয়েস’ সেবা দেওয়া হয় তাহলে ওপেনসোর্স থেকে বিনামূল্যেই ‘ভিসি ডায়েল’ সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করা যায়। সফটওয়্যারটি কাস্টমাইজ করা যায়। আমার ব্যবসার শুরুতে না জানার কারণে বিনামূল্যের এ সফটওয়্যারটি ২০ লাখ টাকায় কিনতে হয়েছিল। অবশ্য এরপর আমিই অনেককে এটি ফ্রিতে দিয়েছি। যেটা ফ্রিতে পাওয়া যায় সেটার জন্য অর্থ ব্যয়ের দরকার নেই। তবে সেবার ধরন অনুযায়ী, অনেক সময় ভিন্ন সফটওয়্যারের প্রয়োজন হয়। সেগুলো দামি হতে পারে।
গ্রাহক পেতে
প্রথমেই ঠিক করতে হবে আপনি কী ধরনের সেবা প্রস্তাব করবেন। কল সেন্টার সম্পর্কিত সেবা দিলে আগে দেখতে হবে কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কল সেন্টারের প্রয়োজন হয়। অনেক এনজিওর সার্ভের কাজ থাকে। আবার কারও ডাটা কালেকশনের। এভাবে কাজ অনুযায়ী আগে গ্রাহক ঠিক করতে হবে। গ্রাহক নির্ধারিত হলে চিন্তা করতে হবে আপনার সেবা কীভাবে গ্রাহকের প্রতিষ্ঠানের কাজে আসবে। সেই আঙ্গিকে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। গ্রাহকের জন্য দারুণ একটি প্রেজেন্টেশনও তৈরি রাখতে হবে। তাদের জন্য ‘সার্ভিস মডেল’ বানাতে হবে। সাধারণত আউটসোর্সিং সেবার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসাররা সিদ্ধান্ত নেন। তাদের ফোরামে আপনাকে যেতে হবে। তাদের সঙ্গে আপনার নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে। এ ব্যবসায় মূলত দুভাবে গ্রাহক পাওয়া যায়। প্রথমত ওয়েব রিসার্চের মাধ্যমে। ইন্টারনেটে অনেক ‘লিড জেনারেশন’ কোম্পানি আছে। গুগলে খুঁজলেই হবে। এ ধরনের কোম্পানির কাছে বিপিও প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রাহক হবে এমন সব প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য থাকে। আবার সেসব প্রতিষ্ঠানের যারা গ্রাহক তাদের বিষয়েও তথ্য থাকে। যেমন ধরুন আপনি যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের হয়ে সে দেশের গাড়ি ব্যবহারকারীদের কোনো একটি সেবার প্রস্তাব করবেন। এখন এ বিষয়ে যাবতীয় তথ্য ওয়েবসাইটে থাকা লিড জেনারেশন কোম্পানি থেকে পেয়ে যাবেন। দ্বিতীয়ত গ্রাহকের দেশে বা আঞ্চলিকভাবে অনুষ্ঠিত এক্সপো বা সেমিনারে যাওয়া যায়। যেমন আপনি যে সেবা দেন তার অনেক গ্রাহক আফ্রিকার কোনো একটি দেশে আছে। আপনি সশরীরে সেই দেশে গিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে দেখা করবেন। এভাবে পরিধি বাড়াতে হয়। এর বাইরে অনেক সময় দেশীয় পুরোনো প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক থেকেও নতুন গ্রাহক পাওয়া যায়।
বিনিয়োগ
স্বপ্ন বড় থাকলে বড় বিনিয়োগ লাগবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগেও শুরু করা যায়। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা নিজেরা একসময় ফ্রিল্যান্সিং করেছেন। পরে গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি কাজ পেয়ে তাকে দল বানাতে হয়েছে। একপর্যায়ে সেখান থেকেই হয়েছে কোম্পানি। এমন নজির আছে। তবে এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আপনার প্রতিষ্ঠান নতুন হলে এবং নতুন গ্রাহকের সঙ্গে কাজ করতে গেলে তারা আগে আপনার কোম্পানির কাঠামো দেখবে। লোকবলসহ অন্যান্য সক্ষমতা দেখবে। তাদের বিশ্বাস করতে হবে কাজটা আপনারা পারবেন। তারা এও যেন বোঝেন যে, ডেডলাইনের মধ্যে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা আপনার আছে। কম্পিউটার বা ল্যাপটপ, চেয়ার, টেবিল, হেডফোন এবং অন্যান্য জিনিস মিলিয়ে প্রতি আসনে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা খরচ পড়ে। সেই হিসাবে যদি ১০০ আসন দিয়ে শুরু করেন তাহলে ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ তো এখানেই। সঙ্গে অফিসের অগ্রিম ও ভাড়া যোগ হবে। সঙ্গে ছয় মাস সময়ও লাগতে পারে আপনার প্রথম গ্রাহক পেতে। অন্তত ছয় মাসের পরিচালন ব্যয় রাখতে হবে। কখনো গ্রাহকের পেমেন্ট আসতে দেরি হয়। এসব বিবেচনায় রেখে মূলধন ঠিক করতে হবে। ১০০ জন আসনবিশিষ্ট অফিসে মাসে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা পরিচালন ব্যয় লাগে।
বাক্কো থেকে যেসব সহযোগিতা পাওয়া যায়
বাক্কো সবসময়ই তার সদস্যদের সহযোগিতা করে থাকে। বাক্কোর নির্বাহী বোর্ডের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ থাকে। আবার বিভিন্ন সময় বহির্বিশ্বের বিভিন্ন সেমিনার বা এক্সপোতে বাক্কো অংশগ্রহণ করে। সে সময় বাক্কোর সঙ্গে সদস্যদের যাওয়ারও সুযোগ থাকে। পাশাপাশি দেশেও বাক্কো বিপিও সামিটের মতো এক্সপোর আয়োজন করে। সেখানেও নানা দেশ থেকে গ্রাহকরা আসে। এতে করপোরেট নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ তৈরি হয়।
উদ্যোক্তার পড়াশোনা
এখানে পড়াশোনার চেয়ে বেশি জরুরি হলো, যে ডোমেইনে কাজ করবেন সেই ডোমেইন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা ছাড়া আসা উচিত নয়। এ জন্য প্রয়োজনে পাঁচ থেকে সাত বছর নিজে কোনো বিপিও কোম্পানিতে কাজ করে তারপর নিজের প্রতিষ্ঠান চালু করা। সেটা সম্ভব না হলে এসব বিষয়ে ভালো জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রাখেন এমন কাউকে পরিচালনা পর্ষদে রাখতে হবে।
কর্মীর সহজলভ্যতা
স্থানীয় বাজারের জন্য কর্মী সহজে পাওয়া যায়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য কর্মী পাওয়া কঠিন। অনেকেই ইংরেজিতে কথা বলতে সাবলীল নন। ঢাকার মধ্যে এ ধরনের কর্মী পাওয়া গেলেও ঢাকার বাইরে বিরল। স্থানীয় বাজারেও যারা ভয়েসে কাজ করেন তারা যে সবাই প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারেন তাও নয়। এগুলো বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে আইটি ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মী এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ খাতের মূল কর্মী বাহিনী হচ্ছে মিড লেভেল এবং বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের কর্মীরা। এদের সহজলভ্যতা চাহিদার তুলনায় কম। আবার নাইট শিফটের জন্যও কর্মী পাওয়া যায় না।
ঝুঁকিগুলো কী
এ খাতের বড় ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ হলো গ্রাহককে ঠিকমতো সেবা না দেওয়া। এতে অনেক সময় জরিমানা গুনতে হতে পারে। এমনটা হলে এর প্রভাব শুধু ওই প্রতিষ্ঠানে পড়বে না, বরং দেশের পুরো বিপিও ইন্ডাস্ট্রির ওপর পড়ে।
গ্রাহক যদি মূল্য পরিশোধ না করে?
এটা সাধারণত হয় না। ভালো ক্লায়েন্ট কখনো এমন করে না। তবে বাড়তি নিরাপত্তার অংশ হিসেবে গ্রাহকের দেশে একটি কোম্পানি চালু করা যায় বা স্থানীয় একটি কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারত্ব করা যায়। ভালো হয় নিজেই একটা কোম্পানি খুললে। প্রয়োজনে ২০০-৩০০ ডলার দিয়ে ভার্চুয়াল কোম্পানি খোলা যায়। এতে করে কোনো কোম্পানি চুক্তির বরখেলাপ করলে তার দেশের আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
এআইর কারণে বিপিও ঝুঁকিতে পড়বে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে এমনটা হবে না। বরং এআইর কারণে কাজে গতি আসবে। যেমন ধরেন এখন একটা ইমেজ প্রসেস করতে যে সময় লাগে, এআইর কারণে গতি ৭০-৮০ শতাংশ বাড়বে। এ জন্য কর্মীদের স্মার্ট প্রসেসিংয়ে আনতে হবে। আজ যে ঘণ্টায় ২০টা ছবি প্রসেস করছে, তাকে আগামীতে ৫০টা করতে হবে। সবকিছুর পর একটা ম্যানুয়াল ‘হিউম্যান টাচ’ তো লাগেই।
মন্তব্য করুন