চাঙ্গে ওঠার মতো রাজনীতি ঘরে উঠে গেছে। আওয়ামী-জাতীয়তাবাদী, লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-গোলাপি ইত্যাদি ভেদাভেদ ভুলে একাট্টা হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। স্বার্থগত সমীকরণে তাদের সঙ্গী হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একই সময়ে মাঠে শিক্ষার্থীদেরও দাবড়ানি। তবে, দাবি, স্বার্থ ও দফা ভিন্ন। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো তা আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। মন্তব্য করে বসেছেন স্বয়ং প্রধান বিচারপতিও। তার প্রশ্ন—‘কোটা নিয়ে এত কীসের আন্দোলন? সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট কি আন্দোলন দেখে বিচার করবেন?’
এমন একটা ভজঘটের আগে রাজনীতির মাঠের উপাদান ছিল এমপি আনার খুন, বেনজীর-মতিউর, ছাগল, বাছুর, রাসেলস ভাইপার ইত্যাদি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ধর্মঘট, শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনসহ নানা ইস্যুর চক্কর। এগুলোই এখনকার রাজনীতি। শিক্ষক আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধসহ শাটডাউন অবস্থা। শিক্ষার্থীরা জিম্মি। আবার দাবি আদায়ে শিক্ষকদের এর বিকল্পও নেই। এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আছে। সরকার গ্রাহ্য করছে না তাদের এ আন্দোলন। সমাজের শ্রেণিবিশেষও সমালোচনামুখর। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে রীতিমতো ট্রল হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটা বিরাট অংশ সর্বজনীন পেনশনসহ সরকারের নানা পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন এতদিন। কিন্তু, তারা নিজেরা সর্বজনীনে আসতে চান না। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ‘প্রত্যয় স্কিম’টি নিয়ে তাদের খুব আপত্তি। ভালো জিনিস নিজে না নিয়ে, না খেয়ে অন্যদের গেলাতে চান কেন—এমন তির্যক প্রশ্ন ছোড়া হচ্ছে। প্রতিদিন অভিনব যত দুর্নীতির গরম খবরের মধ্যে শিক্ষক আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন একঅর্থে সরকারকে কিছুটা সুবিধা করে দিয়েছে। সাবজেক্টে চলে গেছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
বংশীয় ছাগল ও বনেদি নানাজনের আলাদিনের চেরাগ, চল্লিশ চোরের নানা কাণ্ডের সরস আলোচনার মজমা কিছুটা কমে এসেছে। অনেকটা কীসের মধ্যে কী—অবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শাটডাউন অবস্থা। সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয় স্কিমের’ প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে অনড় শিক্ষকরা। এ ক্ষেত্রে কোনো দলবদল নেই। আওয়ামী, জাতীয়তাবাদী, জামায়াতি, ডান-বামের চেতনাবাজি নেই। লাল-নীল-সাদা-গোলাপির প্যানেল রাজনীতি নেই। সব একাকার, একাট্টা। এর আগে প্রত্যয় স্কিম বাতিলে সরকারকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন তারা। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সরকারের কথাবার্তায় সুবিধা করতে পারছিলেন না।
মোটা দাগে শিক্ষকদের দাবি তিনটি—১. সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন বাতিল। ২. সুপার গ্রেডে (জ্যেষ্ঠ সচিবরা যে গ্রেডে বেতন পান) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং ৩. শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো। অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ কয়েকজন বলেছেন, শিক্ষকদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা দেখছেন না তারা। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক-পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা দিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে দেখা দেবেন বলে। কিন্তু দিনের আলোর মধ্যেই ‘না’ করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততার কথা। শিক্ষকদের জন্য এটি লজ্জার ওপর লজ্জার। সরকারের ভেতর থেকে সরকারকে ভুল বোঝানো হচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। অভিযোগের পক্ষে জোরালো মত আসছে না। প্রশ্ন আসছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষক হতে চান, আবার কেন সরকারি চাকরি হিসেবেও দেখতে চান? সুপার গ্রেড চান? আবার রাজনীতিও করতে চান। এমপি-উপদেষ্টা হতে চান? বিশেষায়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ধরনের চেয়ারও চান? গাছেরটাও খাবেন, তলারটাও কুড়াবেন?
এমন সব তির্যক কথার বিপরীতে শিক্ষকদেরও কথা আছে। যুক্তিও আছে। পুলিশ, আমলা, ব্যবসায়ীসহ কিছু মহলের মতো শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পুকুর চুরি, তাজমহল-রংমহল, বাগানবাড়ি বানানোর শতকোটির দুর্নীতি অভিযোগ নেই। শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও অবস্থান নেই তাও সত্য। কিন্তু তা আলোচনায় আসছে না। আর তা আসার কারণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনো শিক্ষকের দলীয় রাজনীতিপনা। এ গোত্রটি সরকারি চাকরির চেয়েও বেশি সুবিধাভোগী। রাজনীতিকদের চেয়েও বেশি রাজনীতিক। নিজ নিজ দলের ক্যাডার দিয়ে সেখানে প্রভাব খাটানোর এ রাজনীতি সব শিক্ষকের জন্যই অসম্মানের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ এখন কতটা মেধার ভিত্তিতে আর কতটা দলীয় আনুগত্যের গুণে হয়, তা গোপন বিষয় নয়। সরকারদলীয় ক্যাডার হয়ে তারা কেন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন—এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন তাদের জন্য। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে এরই মধ্যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, শিক্ষকদের দাবি পরস্পরবিরোধী। তারা স্বায়ত্তশাসনের অজুহাত দিচ্ছেন, আবার স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রণীত বিধি মানতে চাইছেন না।
সরকারের সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি চালু হয়েছে ১ জুলাই। রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ ৪০৩টি সংস্থায় নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের জন্য প্রত্যয় প্রযোজ্য। কিন্তু গত মার্চে প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি, প্রত্যয় কর্মসূচি বৈষম্যমূলক। শিক্ষকদের এ বিরোধিতার জবাবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের জবাব স্পষ্ট। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যার সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) ভোগ করছে। এ সুবিধা কিন্তু বছর বছর কমতে থাকবে। বাড়তে থাকবে বয়স্ক মানুষ। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। সব মানুষ যাতে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে থাকতে পারে, সে কারণেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শিক্ষকদের কাছে এসব কথা পছন্দ নয়।
এমন বিরোধ ও বুঝের গোলমালে একপর্যায়ে এ পাইপলাইনে ঢোকেন একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। শিক্ষকদের সুবিধা-অসুবিধা, পদ-পদায়ন, নেতৃত্ব অনেক কিছু হ্যান্ডেলে এ ছাত্রের অনুঘটক হওয়ার রেকর্ড আছে। তার এবার এতে যুক্ত হওয়ার তথ্যটি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা তাকে ফোন করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বসতে, কথা বলতে। শিক্ষকরা এতে আগ্রহের সঙ্গে পা দেন। ওবায়দুল কাদেরের ডাক পাওয়া তাদের কারও কারও জন্য একটি বড় ব্যাপার মনে হয়। ধাক্কাটা খান তার সাক্ষাৎ ভণ্ডুল হওয়ায়। বিষয়টি মোটেই কোনো সাবেক বা বর্তমান ছাত্রনেতার নয়। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বা সড়ক পরিবহনমন্ত্রীরও নয়। প্রত্যয় কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর পেনশন শুধু শিক্ষকদের জন্য নয়। পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রত্যয় কার্যকর করতে চাইছে ৪০৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ইত্যাদি সংস্থার ওপর। এগুলোর মধ্যে ৯০টি সংস্থা বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের মতো পেনশন দিয়ে থাকে। সেই হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত সংস্থায় ১ জুলাই থেকে নতুন চাকরিতে যোগদানকারীদের প্রত্যয় পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। এসব সংস্থার নতুন চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর প্রচলিত পদ্ধতিতে পেনশন পাবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ সব করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বিএসটিআইসহ ৪০০ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রত্যয় প্রযোজ্য হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদ্মা অয়েল, যমুনা অয়েলসহ সরকারের হাতে ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিকানা রয়েছে, এমন কোম্পানিগুলোতে নতুন যোগ দেওয়া কর্মীরাও আর বিদ্যমান নিয়মে পেনশন পাবেন না। শুরু থেকেই সরকারের নতুন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’ স্কিমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের। তাদের সঙ্গে কর্মচারীরা আছেন। শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত কোটা বিরোধিতায়।
নানা কোটায় ক্ষতবিক্ষত চাকরিপ্রার্থীরা। নারী, মুক্তিযোদ্ধা, পোষ্য, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি কোটা থাকার পরও ঘটনার পরম্পরায় একতরফা আঙুলটা চলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটার দিকে। যত দোষ ও খেদ ওদিকেই। কুকথা-কুতর্কেরও এক ধুম। সেইসঙ্গে জ্ঞানগর্ভ কথার শব্দবোমার বিস্ফোরণ। তা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধাদের জাতগোষ্ঠীকেও প্রতিপক্ষ করে ফেলা হচ্ছে। কোটার নামে নিম্নমানের খোঁটার শিকার তারা। সেইসঙ্গে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের হীনম্মন্যতা। সরকারের জন্য বিষয়টি তামাশা দেখার মতো। মুক্তিযোদ্ধার সঠিক সংখ্যা, sভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, দিয়ে আসা ভাতা উসুল করে নেওয়ার মতো বিষয় পর্যন্ত সামনে চলে আসছে। সরকারের জন্য কি এটি রিল্যাক্সের? জরুরি বিষয়ের বাইরে মানুষকে ইজি কাজে বিজি রেখে নিজে নিস্তার নেওয়ার মতলব নয় তো? বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা কখনো অর্থ বা কোনো সুবিধার দ্বারা বিনিময়যোগ্য হতে পারে না। আর এটা মেনে নিলে গৌরব করারও থাকে না অবকাশ। এমন নির্জলা সত্যের বিপরীত বাস্তবতাও আছে।
বিশেষ প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনেই মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, কোটা, তাদের নাতিপুতিদেরও এর আওতায় আনা হয়েছে। আবার এ নিয়ে অতি রাজনীতিও হয়েছে। এর এক নিদারুণ পরিণতি এখন ভুগতে হচ্ছে অনেককে। সইতে হচ্ছে নানা অপমান, অনাকাঙ্ক্ষিত তিক্ত কথা ও পরিস্থিতি। হতে হচ্ছে দয়ার পাত্র। বলতেই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার—এ তিনটিকে অর্জনের ঘোষণা দিয়ে। সাম্য তৈরি না হলে, সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত না হলে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার নিরর্থক। আর যে কারও জন্য কোটা সেখানে একদম মশকরা। তাচ্ছিল্যের নামান্তর। সেইসঙ্গে কোটাধারীদের কেবল খোঁটা নয়, দস্তুর মতো প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেওয়া। আর মতলববাজদের সুবর্ণ সুযোগ করে দেওয়া। আদতে চলছে সেটাই, যে যা পারছে করছে, বলছেও।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন