বিশ্বের দেশে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসকরা তাদের মতাদর্শ বাস্তবায়নে গণমাধ্যমকে অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কালাকানুন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে গণমাধ্যম। হরণ করেছে মানুষের বাক ও চিন্তা স্বাধীনতা। সাংবাদিকদের করেছে নির্মম নির্যাতন। আবার অনেক সময় সাংবাদিকদের তারা দেশছাড়া করেছে। অন্যদিকে গড়ে তুলেছে নিজস্ব মতাদর্শের গণমাধ্যম ও দালাল সাংবাদিক। তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে। এর বিনিময়ে তারা ফ্যাসিবাদী শাসকের সব ধরনের অন্যায় অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে যারা ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলেও আমরা এই ধারা প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেছেন একদল নির্বাসিত সাংবাদিক। সমাজ-সংসার ফেলে বিদেশবিভুঁইয়ে কাটানো এসব মানুষ দেশ ছাড়লেও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদে মুখর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার ও সরকারি দলের লোকজনের নানা অপরাধ, দুর্নীতি, গুম, খুন ও নিপীড়নের খবর তথ্যসহ তুলে ধরতেন। কেউ কেউ প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশে রাখতেন বড় ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত এ সচেতন মানুষের ভূমিকা গণতন্ত্রকামী মানুষকে দিয়েছিল আন্দোলনের ভিন্ন রসদ। দৈনিক ইত্তেফাক, ইউএনবিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কূটনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে বেশ উজ্জ্বল মুখ ছিলেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। জনপ্রিয় বৈশ্বিক গণমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান সামি। সুইডেনভিত্তিক গণমাধ্যম নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনীম খলিল। ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকা বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য। ব্যক্তিজীবনে চিকিৎসক হলেও তিনি সবসময় মানবাধিকার নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। যার ফলে দেশ ছাড়তে হয় তাকে। বিদেশে অবস্থানকালে তিনি যেন মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি ও দলবাজির কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি ইউটিউবে তুলে ধরতেন বিশ্লেষণাত্মক মতামত। সাধারণ মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় শিক্ষক বাবার সন্তান পিনাকীর গ্রামের বাড়ি দেশের বগুড়া জেলায়। টুঁটি চেপে রাখা গণমাধ্যমের নানা অনিয়ম, সুবিধাবাদী সাংবাদিক এবং সরকারের দুর্নীতি, শোষণের নানা চিত্র তুলে ধরে সবসময় আলোচনা ছিলেন লন্ডনে নির্বাসিত সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অসংখ্য মামলাও করেছেন সরকারের সুবিধাভোগীরা। গ্রামের বাড়িতে হামলা, বাবা-মাকে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। দেশীয় গণমাধ্যমের আলোচিত মুখ মোস্তফা ফিরোজ। স্বৈরাচারী সরকারের রোষানলে পড়ে দেশ ছাড়তে হয় তাকেও। দেশে হুমকির মুখে পড়লেই তিনি চলে যেতেন বিদেশে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বসে কাজ করতেন। সেখানে বসে সরকারের নানা অন্যায় আর অনিয়ম নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন এই সাংবাদিক। ফেসবুক ও ইউটিউবে নিয়মিত সমালোচনামূলক ভিডিও আপলোড করতেন মোস্তফা ফিরোজ। দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও তুলে ধরতেন আন্তর্জাতিক মহলে।
একসময়ের জনপ্রিয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন। সরকারের রোষানলে পড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অনেক মামলা রয়েছে। তবে বিদেশে অবস্থান করলেও ইলিয়াস হোসেন নানা তথ্যনির্ভর সংবাদ প্রকাশ করেন নিজের ফেসবুক আইডি ও ইউটিউব চ্যানেলে। বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে আলোড়ন তোলেন দেশের মিডিয়াপাড়ায়। টেলিভিশন সাংবাদিকতায় জনপ্রিয় মুখ শাহেদ আলম। সরকারের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে বসেও সরকারের নানা অনিয়ম নিয়ে ছিলেন সোচ্চার। ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে তাদের অবদান ভুলবার নয়।