আমার গ্রামের মানুষগুলো ছিল সরল, ছিল ধর্মবল। ছিল না বিবাদ, তারা মিলেমিশে দিন কাটাত। যতদূর মনে পড়ে আমার বাবার হাত ধরে যখন গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতাম বা স্কুলে যেতাম, তখন মুরুব্বিরা আমাকে ‘মাস্টর’ বলে ডাকত। তখন আমি এর অর্থ বুঝতে পারতাম না। প্রাপ্তবয়সে এসে বুঝতে পারি যারা লেখাপড়া করে এবং বড় হয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসে, তাদের আমার গ্রামের বড়রা সম্মানের সঙ্গে ‘মাস্টর’ বলে সম্বোধন করতেন। কেননা তখন গ্রামে প্রাইমারি স্কুল ছিল এবং স্কুলের শিক্ষকরা যেমন ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগী ছিলেন, তেমনি সমাজের মানুষের কল্যাণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, আদিকাল থেকেই শিক্ষা ও সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষার অন্যতম উপাদান হলো শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের অভিমত ও তার প্রয়োগই পারে শিক্ষার কাজ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে। ক্রো রিচির মতে, ‘শিক্ষার সর্বস্তরে শিক্ষকই হলেন শিক্ষা কর্মের মূল উৎস।’ একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেন। শিক্ষকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ন্যায়, নিষ্ঠা, আদর্শ ও আত্মত্যাগ। তার অনুপ্রেরণায় শিক্ষার্থীরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে বদলে দিতে পারে।
শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। আজকের শিশুকে আগামী দিনের সুনাগরিক, ভালো মানুষ ও নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষক বিদ্বান, জ্ঞানতাপস, নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, সৎ উপদেশদাতা, ব্যক্তিত্ববান, চরিত্রবান, স্বাস্থ্যবান, দায়িত্বশীল, সত্যবাদী, রুচিশীল, দয়ালু, আবেগের ভারসাম্য রক্ষাকারী, নিরপেক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আন্তরিক ও সাহসী হয়ে থাকেন। দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষকের দায়িত্ব সমাজের অন্য সব কাজ ও পেশা থেকে ভিন্ন। অথচ এ সত্য আমরা অনুধাবন করছি না। আর তাই সমাজ ও রাষ্ট্রকে বড় মূল্য দিতে হচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে শিক্ষার মান নির্ভর করে শিক্ষকের মানের ওপর। তাই প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মানসম্পন্ন যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের অর্জনই শিক্ষার মান ও শিক্ষকের মানের প্রধান মাপকাঠি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্ধেক সংখ্যক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। ফলে শ্রেণিকক্ষে শতাধিক ছাত্রকে পাঠদানের বৃথা চেষ্টা করেন একজন শিক্ষক। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত জেলাভেদে ২৮ থেকে ৭২ জন। অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আবশ্যিক বিষয়সমূহে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই (সূত্র: ব্যানবেইস)। শিক্ষকদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গঠনে শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন গুরুত্ব নেই।
মনোবিজ্ঞানী লিন্ডগ্রেনের মতে, শিক্ষার্থী হলো শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। তাকে লক্ষ্য করেই গড়ে ওঠে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীবিহীন কোনো ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা যায় না। তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে সফল করতে হলে শিক্ষার্থীকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, পরিপক্বতা, বিশেষ প্রবণতা, স্বাস্থ্য, প্রেষণা, মনোভাব, মনোযোগ, স্মৃতি, শারীরিক, মানসিক বিকাশ, আবেগীয় পরিপক্বতা এসব বিষয় আমলে নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে।
বিশেষ করে আমাদের দেশে জুলাই বিপ্লব ২০২৪-পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক সম্পর্কের বিষয়টি নতুনভাবে সামনে এসেছে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে বর্তমানে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে শিক্ষকের মতামত যেমন গুরুত্ব পাবে তেমনি গুরুত্ব পাবে শিক্ষার্থীদের চিন্তাচেতনা। আজ আমরা যাদের জেন-জি বলছি, তাদের চিন্তা, চেতনা, চাহিদা সৃজনশীলতা দেশকে যেমন মুক্ত করেছে; তেমনি আগামীতে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করবে, সহায়তা করবে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের সুফল ঘরে তুলে দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে এগিয়ে নিতে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (২০১৫) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রযুক্তির অগ্রগতি সমাজের মূলধারার রূপান্তরে সহায়তা করবে। ফলে আগামী দিনের ডিজিটাল ও আধুনিক বিশ্ব অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত থাকবে। আগামী ১০ বছরেই এসব ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের মাধ্যমেই এ ব্যাপক রূপান্তর বা পরিবর্তন ঘটবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জরিপ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে যেসব পরিবর্তন ঘটবে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
ইন্টারনেটে সংযুক্ত হবে ১ হাজার কোটি সেন্সর; যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করবে প্রথম রোবোটিক স্বাস্থ্যকর্মী; পড়াশোনার জন্য ব্যবহৃত চশমার ১০ শতাংশ ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকবে; ৮০ শতাংশ লোকের ইন্টারনেটে ডিজিটাল উপস্থিতি থাকবে; ত্রৈমাত্রিক মুদ্রণের মাধ্যমে প্রথম মোটরযান নির্মাণ হবে; ডাটা উৎস দ্বারা সরকার প্রথমবারের মতো আদমশুমারি প্রতিস্থাপন করবে; প্রথমবারের মতো প্রতিস্থাপনযোগ্য মোবাইল ফোন বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হবে; বিশ্বের ৯০ শতাংশ লোক স্মার্টফোন ব্যবহার করবে; ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকবে ৯০ শতাংশ লোক; যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় শতকরা ১০ ভাগ যানবাহন চালক ছাড়াই চলবে; ত্রিমাত্রিক মুদ্রণে প্রথমবারের মতো যকৃত স্থাপন হবে; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ৩০ শতাংশ করপোরেট অডিট সম্পন্ন করবে; ৫০ শতাংশ ইন্টারনেট সংযোগ অ্যাপ্লায়েন্স ও ডিভাইসের জন্য থাকবে; ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে রাইড শেয়ারিংয়ে দুনিয়া ভ্রমণ সম্পন্ন হবে; প্রথমবারের মতো ৫০ হাজারের বেশি অধিবাসীর শহরে ট্রাফিক লাইট থাকবে না; করপোরেট পরিচালনা পর্ষদে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হবে।
চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের ফলে পরিবর্তনের এসব সুবিধা নিতে হলে প্রয়োজনে ‘জেন-জি’কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যারা জন্ম নিয়েছে, তারাই জেন-জি। এরা কথোপকথন, লেখাপড়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে। এরা জুম ও অন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে পড়াশোনা করেছে। এরা গ্লোবাল সিটিজেন এবং ইন্টারনেট অধিক ব্যবহার করে। ইতিহাস বলে, এদের পরিশ্রমী হাত ধরে আসবে নতুন এক সমাজব্যবস্থা।
জেন-জির মাধ্যমে এসব সুবিধা নিতে হলে প্রয়োজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক এবং আস্থাশীলতা। গ্রামে একটি প্রবাদ আছে—‘বাপে বানায় ভূত, মাস্টারে বানায় পুত।’ অর্থাৎ একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রভাবে তার শিক্ষার্থী সফল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। কথায় বলে— ‘আমি জিতলে জিতে যায় মা।’ একজন শিক্ষকের সন্তান যখন যোগ্যতা ও দক্ষতায় তাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন তিনি যেমন অন্তর থেকে আনন্দিত হয়ে থাকেন, তার শিক্ষার্থীর সফলতায়ও যদি একইরকম অনুভূতি আসে, তবেই শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের ইতিবাচক পরিণতি পায়। এরূপ গুণাবলিসম্পন্ন শিক্ষকের অভিমত প্রাধান্য দিলে শিক্ষার্থীকে গুণগত শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করে; ফলে সমাজ ও দেশ উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যক্ষ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ, ঢাকা।