নারী। সৃষ্টির গৌরব। অবস্থা ও অবস্থানে রয়েছে পরিবর্তনের ছাপ। কর্মে-চেতনায় স্বতন্ত্র। দক্ষতা ও সাহসিকতায় শীর্ষে। ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সমকালীন বিশ্বে নারী নেতৃত্ব বা নারীর চিন্তাধারা অনেকটাই সুপ্রতিষ্ঠিত। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রশংসার ঝড় বিশ্বজুড়ে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী ৮ মার্চ এ দিবসটি পালন করা হয়। বিশেষ করে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের স্বীকৃতি, ভালোবাসা প্রকাশের মধ্য দিয়ে পালন করা হয় দিবসটি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়। নারীর ওপর হওয়া বৈষম্য, নির্যাতনের বিরুদ্ধে করা প্রতিবাদে নারীদের জাগ্রত করাই নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
নারী দিবসের প্রতীক বেগুনি রং। নারী দিবস মূলত বেগুনির সঙ্গে সাদার মিশেল কিংবা শুধুই বেগুনি। নারী দিবসের বেগুনি রং ভেনাসের, যা কি না নারীরও প্রতীক। কারণ বেগুনি নির্দেশ করে সুবিচার ও মর্যাদার; যা দৃঢ়ভাবে নারীর সমতায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম শেষে বেগুনি রং এখন নারীবাদীদের প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি দিবসে আলাদা রঙের প্রতীক হওয়ার পেছনেও আছে ভিন্ন ইতিহাস। যেমন—বিশ্ব ‘শান্তি দিবস’ সবুজাভ নীল, বিশ্ব ‘শ্রম দিবস বা মে দিবসে’ লাল, পরিবেশ দিবসে ‘সবুজ রং’ ইত্যাদি।
জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগান ‘For ALL women and girls : Rights, Equality, Empowerment’. এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে—‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন’।
এ প্রতিপাদ্যটি সময়োপযোগী। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ১৭, ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে জীবনের সবক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার ও ক্ষমতায়ন এবং নারী ও শিশুর সুরক্ষার মাধ্যমে মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৭২ সালে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড’। ১৯৭৪ সালে এ বোর্ডকে ‘বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এ রূপান্তর করা হয়, যা পরবর্তীকালে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে উন্নীত হয়। এ ছাড়া কিশোরীদের নেতৃত্ব বিকাশ, দেশপ্রেম ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ‘গার্ল গাইড অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ প্রণয়নের আগেই ১৯৭৪ সালে শিশু আইন পাসের মাধ্যমে শিশুর অধিকার ও সার্বিক সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। (সূত্র: মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর)। এরই ধারাবাহিকতায় নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে একটি সমতাপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল সৃষ্টি করেছে। তবে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স-২০২৪-এর সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতা সূচকে বড় পতন হয়েছে বাংলাদেশের।
বার্ষিক এ সূচকে গত বছরের তুলনায় ৪০ ধাপ পিছিয়ে ১৪৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ৯৯তম। অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের অবস্থা আরও নাজুক। এ অঞ্চলে বাংলাদেশ এবারও সবচেয়ে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে, যেখানে পাকিস্তান সবার নিচে। সমীক্ষার চিত্র সন্তোষজনক না হলেও আশার আলো—বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাতে অভাবনীয় উন্নতি লাভ করেছে। এ খাতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমান অংশগ্রহণ প্রশংসার দাবি রাখে। এতে বেগবান হয়েছে অর্থনীতির চাকা।
দৃষ্টি সম্প্রসারিত করলে দেখা যায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রবণতা বেড়েছে ব্যাপক হারে। নারীরা বিশেষ করে প্রোগ্রাম তৈরি করা, বাণিজ্যিকভাবে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট, ইমেইল, বায়োডাটা প্রস্তুত করা, গ্রাফিকস ডিজাইন তৈরি, অনলাইন শপিং, তথ্য আদান-প্রদান, স্বাস্থ্য, কৃষিবিষয়ক তথ্যসেবা দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। নিজ নিজ বাড়ি বা বাসার পাশে ছোট ছোট দোকান নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা। এটি যেমন অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর, তেমনি পরিবার ও সমাজের জন্য সমানভাবে কল্যাণকর। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ সুগম ও সহজলভ্য হয়েছে। এতে এ খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও বাড়ছে দিন দিন। প্রয়োজন এ প্রযুক্তিকে টেকসই, সহজলভ্য ও সুলভ করা।
দীর্ঘ পথচলায় পিছিয়ে নেই নারীরা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, সেনা, নৌ, পুলিশ, বিজিবি, সাহিত্য, শিল্পসহ সর্বোচ্চ বিচারিক কাজেও নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্য এখন লক্ষণীয়। প্রথম নারী উপাচার্য, প্রথম নারী পর্বতারোহী, প্রথম বিজিএমইএ নারী সভাপতি, প্রথম নারী মেজর, প্রথম নারী স্পিকার, প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নারী উপদেষ্টাসহ সবক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান ক্রমেই উজ্জ্বল।
কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে নারীদের যেমন জীবনের ঝুঁকি আছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও আছে। আর এই চ্যালেঞ্জই নারীর শক্তি, কাজের প্রেরণা। পরিবারেও একজন নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবারে নারীর বিভিন্ন রূপ। কখনো কন্যা, কখনো স্ত্রী, কখনো জননী। আর এসব ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেখানে নারীর নিজের সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার নেই, সেখানে হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় বাংলাদেশের সব মাকে স্বস্তি দিয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রের সব ধরনের ফরমে এখন থেকে অভিভাবকের ঘরে বাবা ছাড়াও মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম উল্লেখ করা যাবে। আগে ফরমে শুধু বাবার নাম ব্যবহার করতে হতো। পরে সেখানে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করা হয়। আর এখন যে রায় দেওয়া হলো তাতে অভিভাবক হিসেবে শুধু মায়ের নামও উল্লেখ করা যাবে।
এত কিছুর পরও মর্যাদা ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে নারীকে অবহেলা ও অবমূল্যায়ন করা হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অবদান খাটো করে দেখা, কৃষিতে প্রচুর অবদান থাকা সত্ত্বেও মর্যাদা না দেওয়া, ঘরের কাজের আর্থিক মূল্যায়ন না করা, শিল্পক্ষেত্রের অবদান গুরুত্ব না দেওয়া, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার—এ অচলায়তন ভেঙে এখনো বের হওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ছে সহিংসতা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি। উত্তরণের উপায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
নারীর ইতিবাচক পরিবর্তন ও অর্জন—এসব কিছুই আমেরিকায় ঘটে যাওয়া আন্দোলনের স্বীকৃতি। প্রত্যেক মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান, অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেই প্রতিবাদ করতে চায়, রুখে দাঁড়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এ ন্যায্য অধিকার ও সম্মানের দাবিতে নারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করেন, যা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করলেও সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পায়নি নারী। সে কারণে নারীর কর্মপরিধি বা সেবাদান সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অফিস ও ঘরের কাজসহ বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে, যা নারীদের শারীরিক ও মানসিক অবসাদগ্রস্ততার ঝুঁকিতে ফেলছে।
সব মহলে নারীকে নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন মানসিক অবস্থার পরিবর্তন। ঘুচবে বৈষম্য। সহজ হবে অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠার পথ। এক কথায় নারীর ক্ষমতায়ন মানেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। অর্থাৎ কোনো বাধা ছাড়াই তার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা। তাহলেই ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। পুনরুদ্ধার হবে মর্যাদার আসন।
লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও প্রধান
কমিউনিকেশন, পাবলিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, উদ্দীপন
মন্তব্য করুন