কথা হচ্ছিল তরুণ এক সাংবাদিকের সঙ্গে সহিংসতার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে। কথা এগোতে এগোতে একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘এই যে নতুন এক মব সহিংসতার বিস্তার ঘটছে’। ‘না’, থামিয়ে দিলাম তাকে, ‘যে মব সহিংসতার কথা বললেন, এটা নতুন নয়’, বলি আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধুটিকে। ‘আমাদের যৌবনে স্বাধীনতার পর পরই ঢাকার রাস্তায় মব সহিংসতা দেখেছি আমরা’, খোলসা করি তার কাছে। ‘একটা ঘটনার কথা মনে আছে। ১৯৭২ সালের প্রথম দিককার কথা। বায়তুল মোকাররামের পাশে জিপিওর রাস্তার ওপরের ঘটনা। আমি সবে জিপিওতে একটা চিঠি ফেলে রাস্তায় নেমেছি, ঠিক তখনই পল্টনের দিক থেকে ‘ধর্, ধর্, মার্, মার্’ শোরগোল শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি, একটি ১৮ থেকে ১৯ বছরের ছেলে প্রাণপণে মসজিদের দিকে দৌড়ুচ্ছে, আর তার পেছনে একদল লোক ছুটছে ছেলেটিকে ধরার জন্যে, আমি দম নিই।
‘এক পলক তাকিয়ে দেখি, ছেলেটির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, গায়ের শার্ট শতচ্ছিন্ন, মাথার চুলগুলো ধুলোমাখা। বুঝলাম, ছেলেটি প্রাণভয়ে মবের কাছ থেকে পালাতে চাইছে। পেছনের লোকগুলো কত দূরে আছে, সেটা বুজতে একবার শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, আর তখনই মব চিৎকার করে উঠল, ‘মার, মার শালাকে। ধর হারামজাদাটাকে। মার বিহারিটিকে।’ হঠাৎ করে ঠোক্কর খেয়ে ছেলেটা মাটিতে পড়ে গেল। আর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একদল হিংস্র উন্মত্ত দানব লাঠি, ইট আর ছুরি নিয়ে। কিছুক্ষণ পর দেখি একটি রক্তাক্ত মানুষের প্রাণহীন দেহ রাস্তার ওপরে। তাই বলছিলাম, মব সহিংসতা নতুন নয়, অর্ধশতাব্দী আগে আমি তা দেখেছি।’ আমি কথা শেষ করি এই বলে, ‘আসলে কি জানেন, মানুষের দানবীয় পাশবিকতা মরে না, তারা শুধু ভোল পাল্টায়।’
আমার কথা শেষ হলে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে আসে সারা ঘরে। আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধুটি একটু নড়েচড়ে বসেন। একটু অস্বস্তি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকান। আমি হাতে ধরা চায়ের পেয়ালাটি প্রায় নিঃশব্দে টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখি। কিন্তু আলাপ আর জমে না। কিছুক্ষণ এটা-ওটা ছুটকো কথার পর কাগজপত্র গুছিয়ে তিনি উঠে পড়েন। আমি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিই।
ফিরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এই মব সহিংসতা ঘটে। এটা তো কোনো দুজন ব্যক্তির দ্বিপক্ষীয় সহিংসতা নয়। এটি একটি যূথবদ্ধ আক্রমণ, এমনকি দ্বিপক্ষীয় সহিংসতা হলেও, একটি পক্ষ অন্যদের ‘মবিলাইজ’ করে, তাতিয়ে তোলে, তারপর আক্রান্ত ব্যক্তি বা স্থাপনার ওপরে আক্রমণ চালায়। যারা জড়ো হয়, তারাও ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে না, ভালো-মন্দ বিচার করে না, কোনো যুক্তির ধার ধারে না। উত্তেজিত হয়ে, রোষ এবং জোশ উভয়ের বশেই তারা সহিংস কাজটি করে। কিন্তু কেন?
আশপাশের সব কিছু দেখে, আমার তিনটে কথা খুবই মনে হয়। তবে এগুলো আমার একেবারেই নিজস্ব ব্যাখ্যা— এগুলো ভ্রান্তও হতে পারে, অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তার ওপর আমি কোনো মনস্তত্ত্ববিদ কিংবা অপরাধবিজ্ঞানীও নই। আমার কথাগুলো সমাজ-সচেতন সাধারণ একজন নাগরিকের কথা।
মব সহিংসতার ঘটনাগুলো দেখে মনে হয়, এর কিছু পূর্বপরিকল্পিত, কিছু স্বতঃস্ফূর্ত। নিজের কোনো অপউদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কেউ মব সহিংসতা ঘটায়। একা করতে পারবে না কিংবা তার নিজস্ব দায় থাকবে না বলে সে অন্যদের মবিলাইজ করে। তা ছাড়া পন্থা হিসেবে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং পুরোনো শত্রুতার কারণে, কারও বা কোনো কিছুর ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে, কিংবা স্রেফ লুটপাটের জন্যে মব সহিংসতার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন ঘটানো হয়। অন্যেরা কেন যোগ দেয়? হয় হুজুগে, কিংবা ফাঁকতালে তাদের কোনো ইচ্ছা পূরণের জন্যে। এই যেমন, লুটপাট হলে, তারাও কিছু কিছু লুট করতে পারবে; ঘটনায় নারীরা সম্পৃক্ত থাকলে তাদের গায়ে হাত দিতে পারবে, কিংবা ভাঙচুরের আনন্দে শরিক হতে পারবে। পরিকল্পিত মব সহিংসতার একটি উৎস থাকে ধর্ম, অন্যটি রাজনীতি। ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে এ যুক্তি কিংবা ধর্মীয় সংঘাত বিভিন্ন দেশে মব সহিংসতার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যেও মব সহিংসতা পন্থা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
স্বতঃস্ফূর্ত মব সহিংসতায় কোনো নেতা বা পরিকল্পনাকারী থাকে না। কোনো ঘটনা বরদাস্ত না করতে পারলে, বা যে কোনো কারণে অন্যকে শায়েস্তা করার জন্যেই যৌথভাবে সহিংস আক্রমণ চালানো হয়। স্বতঃস্ফূর্ত মব সহিংসতায় কারা যোগ দেয়? যোগ দেয় ‘মব জনতা’—যারা কর্মহীন, দরিদ্র, শিক্ষারহিত, পেটোয়া। এদের বেশিরভাগেরই বয়স, ধারণা করি, ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে, এবং মবের অংশ হওয়া এদের নেশা এবং পেশা দুটোই।
স্বতঃস্ফূর্ত মব সহিংসতার পেছনে কি জাতীয় মানসিকতা কাজ করে? আমার মনে হয়, তিন ধরনের মানসিকতা। প্রথমটি হচ্ছে ক্ষোভের। যাপিত জীবনের নানান দিকে বহু নানান বঞ্চনা, সমাজে ন্যায্যতার অভাব, অসাম্য ও বৈষম্য মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। বিশেষত: যখন এ জাতীয় বঞ্চনা, অন্যায়, অসাম্য ও বৈষম্য শুধু বঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক জীবনেই দেখা যায় না, তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনেও ব্যাপ্ত। এ জাতীয় ক্ষোভ একটু একটু করে পুঞ্জীভূত হয়ে বঞ্চিত মানুষকে একদম খাদের কিনারে নিয়ে যায়। সুতরাং বঞ্চিত মানুষের বহুদিনের জমানো ক্ষোভ ফেটে পড়ে মব সহিংসতার মধ্যে। এবং যৌথভাবে এটা করে বলে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সংহতি অনুভব করে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্ষমতায়নের। বঞ্চিত মানুষ কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা ভোগ করে না, তাদের মত প্রকাশের কোনো ক্ষেত্র নেই। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। একটা ক্ষমতাহীনতার অসহায়ত্ব তাদের কুরে কুরে খায়। মবের অংশ হিসেবে তারা যখন তাদের যা ইচ্ছা তা করতে পারে, সেটার মাধ্যমে সারা জীবনের বঞ্চিত মানুষ এক ধরনের ক্ষমতা অনুভব করে। মব সহিংসতার মাধ্যমে বঞ্চিত মানুষরা ক্ষমতায়ানের একটি স্বাদ পায়।
তৃতীয়টি হচ্ছে শ্রেণি-চেতনার। আমাদের সমাজে শ্রেণিবৈষম্য অত্যন্ত প্রকট—আয় ও সম্পদের বৈষম্য, সামাজিক অবস্থানের অসমতা, জীবন ধারার অসাম্য, সুযোগের ফারাক এত বেশি যে, সমাজে একটি তীব্র মেরূকরণ বিদ্যমান। যখন বঞ্চিত মানুষ দেখে যে ধনিক শ্রেণির এত আছে এবং তাদের কিছুই নেই; যেখানে ধনিক শ্রেণি বিলাসবহুল এক জীবনযাপন করছে, অথচ তাদের যাপিত জীবন মানবেতর। তথ্য প্রযুক্তির বিস্তারের কারণে অসমতার বিস্তার আর গভীরতা বঞ্চিত শ্রেণির কাছে আরও পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্বেষ বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মনে জন্ম নেয়। মব সহিংসতা ক্ষেত্র বিশেষে সে শ্রেণি বৈষম্যের প্রতিফলনও হতে পারে। শ্রেণি চেতনাও সেখানে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে।
শেষের কথা বলি। ‘মব ভায়োলেন্সকে’ ‘মব জাস্টিস’ বলে যৌক্তিকতা দানের প্রচেষ্টা পরিপূর্ণভাবে অন্যায়। ন্যায্যতা অনেক উঁচু মার্গের বিষয়। সহিংসতার মতো বিকৃত একটি পন্থা দিয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্যে যৌক্তিক, অর্থবহ, এবং প্রাসঙ্গিক অনেক পন্থা আছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সেগুলোর ব্যবহার ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। সেইসঙ্গে ‘মব ভায়োলেন্সকে’ কিছুতেই ‘মবোক্রেসির’ সমার্থক বলা যায় না। একটি হিংসাত্মক প্রক্রিয়াকে ‘ডেমোক্রেসির’ সঙ্গে তুলনা করা অন্যায়। চূড়ান্ত বিচারে, ‘মব ভায়োলেন্স’ হিংস্র সহিংসতা ভিন্ন কিছুই নয়।
লেখক: ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য করুন