সাঈদ খান
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৮:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

খুনি, ধর্ষক, ডাকাত—কোথা থেকে এলো?

খুনি, ধর্ষক, ডাকাত—কোথা থেকে এলো?

সমাজে ধর্ষক, খুনি, চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, দুর্নীতিবাজ, মাদকাসক্ত এবং বিকৃত মস্তিষ্কের মতো ব্যক্তিরা সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এ সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য সব অপরাধের উৎপত্তির মূল কারণ। একটি সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ন্যায়বিচার, সুশাসন, সুষম উন্নয়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, যেখানে নাগরিকরা সঠিক নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় গড়ে ওঠে। কিন্তু একটি দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অব্যবস্থাপনায় আক্রান্ত রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপরাধীদের জন্ম হয় এবং তারা সমাজে দুঃশাসনের প্রতিচিত্র হয়ে ওঠে।

এরা জন্মগতভাবে কোনো নির্দিষ্ট দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় তৈরি হয় না; বরং অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ফলে তাদের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠন করা, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার হবে। শুধু তখনই আমরা একটি অপরাধমুক্ত ও সুস্থ দেশ, রাষ্ট্র বা সমাজ গঠন করতে পারব।

আইনের শাসনের অভাব, বিচারহীনতা ও লিঙ্গবৈষম্য যে রাষ্ট্রে বেশি রয়েছে, সেখানে ধর্ষণের হার বেশি দেখা যায়। দুর্বল বিচারব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহার খুনের হার বাড়ায়। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যেখানে প্রকট, সেখানে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বেশি ঘটে। গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব ও সুশাসনের দুর্বলতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। রাষ্ট্র যদি মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় এবং যুবসমাজ কর্মসংস্থান না পায়, তবে মাদকাসক্তির হার বেড়ে যায়। শিক্ষার মানের অবনতি, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা, অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা যেখানে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়, সেখানে বিকৃত মানসিকতার অপরাধী তৈরি হয়।

বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্র যদি কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকরা অপরাধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। দারিদ্র্য মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ, যা অপরাধ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। দুর্নীতি ও সম্পদের অসম বণ্টন অপরাধকে উৎসাহিত করে। সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্বল শাসন অপরাধের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। অপরাধীরা শাস্তির ভয় না থাকায় আরও সাহসী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রশাসনকে দুর্বল করে এবং অপরাধীদের রক্ষা করে। যুদ্ধ, সংঘাত ও রাজনৈতিক সহিংসতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, যা অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।

সমাজে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অভাবে অপরাধের মাত্রা বেশি থাকে। নারীর প্রতি অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি ও লিঙ্গবৈষম্য ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে। ন্যায়বিচারের অভাব, অসৎ জীবনযাপনের প্রতি সামাজিক সহানুভূতি ও মাদককে ‘ট্রেন্ড’ হিসেবে দেখার প্রবণতা অপরাধের সংস্কৃতিকে লালন করে। মানসিক স্বাস্থ্যের অবহেলা সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যা সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। দুর্বল অর্থনীতি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে এবং এর ফলে সামাজিক মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই চক্রাকার প্রক্রিয়া অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ব্যক্তিমালিকানা ও মুক্তবাজার অর্থনীতি আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক ভিত্তি, যা সম্পদের সৃষ্টি, বণ্টন ও ব্যবহারে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলোর পাশাপাশি অনেক নেতিবাচক রয়েছে। যেমন—শ্রম শোষণ, সম্পদের অসম বণ্টন অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে, যা সমাজে অস্থিরতা ও অপরাধ প্রবণতা বাড়ায়। ভোগবাদী সংস্কৃতি লোভ ও দুর্নীতির প্রসার ঘটায়, যা চুরি, ডাকাতি ও দুর্নীতির মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে। ধনীরা লোভ ও ক্ষমতার লড়াইয়ে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়। যে কারণে দেশে সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে, যা অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

বর্তমান বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, রাহাজানি ও দুর্নীতি অনেকগুণে বেড়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। জনগণ আগের চেয়ে আরও বেশি অনিরাপদ বোধ করছে। গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে মব-সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, যা সহিংসতা ও দমনপীড়নকে আরও উৎসাহিত করছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সম্পদ লুটপাট এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর দমনে সহিংসতা ব্যবহার করা হচ্ছে। কিশোর গ্যাং খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অদক্ষতা ও সরকারের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে অপরাধীরা আইনের আওতায় আসছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি এবং মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য সাধারণ মানুষকে দুর্দশায় ফেলেছে। এসব মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতায় জনগণের হতাশা ও ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছে।

আমাদের সমাজে অপরাধী, দুর্নীতিবাজ, মাদকাসক্ত ও বিকৃত মানসিকতার মানুষের জন্ম আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রব্যবস্থার অসমতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক দমননীতি ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ফল। যখন সম্পদের অসম বণ্টন হয়, তখন বঞ্চিতশ্রেণি দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অবহেলার শিকার হয় আর ক্ষমতাবানরা অবৈধভাবে সম্পদ আহরণ করে প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখে। এর ফলে সমাজে বৈষম্য, ক্ষোভ ও অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকে।

করণীয়: আপাতত, দেশে অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হয়ে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগে সব রাজনৈতিক দল, স্থানীয় সম্প্রদায় ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রতিটি গ্রাম, শহর ও পাড়া-মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে অপরাধ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। একইভাবে গণমাধ্যমগুলোকে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে জনগণকে অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সমন্বিত এ প্রচেষ্টাই অপরাধপ্রবণতা কমানোর পথ তৈরি করবে।

আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধর্ষক, খুনি, চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, দুর্নীতিবাজ, মাদকাসক্ত এবং বিকৃত মস্তিষ্কের অপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে সব শ্রেণির মানুষ তাদের শ্রম ও মেধার সঠিক মূল্য পায় এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়লে অপরাধ ও সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, দরিদ্রদের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ হয় এবং তারা অপরাধের পথে না গিয়ে সৃজনশীল কাজে যুক্ত হয়। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে লুটপাট, দুর্নীতি ও মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বিলীন হবে।

রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি অপরাধ ও বৈষম্য রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন দমনমূলক নীতি চাপানো হয় এবং রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে, জনগণ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবে এবং প্রশাসন আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহি হবে। দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয় পাবেন না। সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অপরাধ ও সামাজিক অবক্ষয়ের রোধ সম্ভব। সমাজে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ন্যায়ের মূল্যায়ন করা হলে মানুষ অপরাধ থেকে দূরে থাকে। সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তি নারীর মর্যাদা, সমানাধিকার ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠা করে, যা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন কমাতে সাহায্য করবে। একইভাবে যুবসমাজের মধ্যে নৈতিকতা ও সততার মূল্যবোধ সৃষ্টি করা গেলে, দুর্নীতি ও অপরাধ কমে যাবে। অপরাধ ও সামাজিক অবক্ষয়ের এ বাস্তবতা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সমাজ ও রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক-ডিইউজে

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সরকারি সফরে চীন গেলেন সেনাপ্রধান 

সাগরে ভাসমান ১৩ জেলে উদ্ধার, নিখোঁজ ৬

হবিগঞ্জে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে ভয়াবহ আগুন

অ্যাপলের আগে সারপ্রাইজ ‍দিল গুগল

ভয়াবহ আগুনে তুলার মিল পুড়ে ছাই

২১ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার উল্টে নিহত ৩

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

২১ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

৪ দিনের সফরে ঢাকায় পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী

১১

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাড়ল বাস ভাড়া

১২

পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হবে ক্লিন সিটি : চসিক মেয়র

১৩

জুলাই সনদে মিত্রদের ‘কাছাকাছি মতামত’ দেওয়ার পরামর্শ বিএনপির

১৪

সন্তানকে বাঁচিয়ে প্রাণ দিলেন বাবা

১৫

সৈকতে ফের ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

১৬

ইঞ্জিন সংকটে ‘নাজুক’ রেল অপারেশন

১৭

স্পেনে রিয়ালের আর্জেন্টাইন তারকাকে নিয়ে অদ্ভুত বিতর্ক

১৮

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেন আবু তাহের

১৯

মানবিক ড্রাইভার গড়তে নারায়ণগঞ্জে ডিসির যুগান্তকারী উদ্যোগ

২০
X