বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য তিস্তা নদী কেন্দ্র করে একটি বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের দেশের জনগণ, বিশেষ করে যারা দেশের মধ্যে ও প্রবাসে কাজ করছেন, উপকৃত হতে পারবেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা শুধু পানি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারব না, বরং কৃষি, শিল্প, পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হব।
জাতিসংঘ পানিসনদ অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা: বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ ১৯৯৭ এবং পানি সনদ ১৯৯২ স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যা নিতে পারি। আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি বণ্টনের আইন অনুসারে বাংলাদেশের অংশীদারি প্রতিষ্ঠা ও পানি ব্যবস্থাপনায় স্থায়ী সমাধান গ্রহণের জন্য তিস্তা ইকোসিস্টেমভিত্তিক বহুমুখী প্রকল্প শুরু করা উচিত।
তিস্তা ফোরাম আরও গুরুত্ব দেয় যে, তিস্তা নদীতে ঐতিহাসিক প্রবাহের ভিত্তিতে পানির ন্যায্য হিস্যার দীর্ঘমেয়াদি ও বছরের ১২ মাসব্যাপী চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অংশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলমান রাখা এবং জলজ পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পানি প্রাপ্যতার চুক্তি করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রয়োজনে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় স্থায়ী সমাধান করতে সময়ক্ষেপণ না করে এখনই উদ্যোগ নেবে। প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে নিম্নের বর্ণিত কম্পোনেন্টগুলোকে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে কোন খাতে কী ধরনের বরাদ্দ হতে পারে, সে বিষয়ে অংশীদারদের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা সম্পন্ন করা।
প্রকল্পের লক্ষ্য ও উপকারিতা
তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে নিম্নলিখিত কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করা হবে:
১. বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে নদীভাঙনের কারণগুলো নির্ধারণ করা: এ কাজটি জরুরি। নদীটির প্রস্থ কমিয়ে আনার প্রস্তাবনায় যা হবে, নদীবক্ষে অবস্থিত চরগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষ করে ডাউয়াবাড়ী, দক্ষিণ দেউয়াবাড়ী, চরসিন্দুর্না, ভোটেমারী, কলকন্দা, খুনিয়াগাছ ও এরকম বেশ কিছু চর এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং চরে বসবাসরত হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
২. তিস্তা নদী খনন: ডালিয়া পয়েন্ট থেকে ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল পর্যন্ত তিস্তা নদী খনন করে এর নাব্য বৃদ্ধি করা হবে। খনন কার্যক্রম উজান পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে, যাতে দীর্ঘমেয়াদে নদীর জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং বন্যা ও নদীভাঙন রোধ হয়। তিস্তা নদীর প্রাকৃতিক ভূগাঠনিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বজায় রেখে পানি ও পলি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে খননকাজ চালাতে হবে। খননলব্ধ পলিবালুর ব্যবহার উপযোগিতা যাচাই করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে নদীপাড়ে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে। পলিবালুর খনিজ উপাদান নিরীক্ষা করে এবং বিভিন্ন কণার আকার অনুযায়ী তা নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ও নদীপাড়ের ভাঙন রোধে ব্যবহৃত জিও ব্যাগ ভর্তি করে ব্যবহার করতে হবে।
৩. নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ও শাখা নদীর সংযোগ: নদী তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে, যা দুপাড়ের মানুষকে বন্যা ও নদীভাঙনের হাত থেকে সুরক্ষা দেবে। কিন্তু তিস্তা নদীর অববাহিকায় যেসব নদী যেমন বুড়ী তিস্তা, ঘাঘট, বুড়িয়াল, মানস, জমিরজান, সানিইয়ানজান, ভটেশ্বরী, সতী, মরা তিস্তাসহ আরও অনেক শাখা ও উপনদী রয়েছে। এ নদীগুলোর সঙ্গে মূল তিস্তা নদীর সংযোগ সক্রিয় থাকলে বন্যার পানি প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং বন্যার তীব্রতা কম হয়। তাই তিস্তা বহুমুখী প্রকল্পে এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই কর্মসূচি নিতে হবে।
৪. ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে জমি পুনরুদ্ধার: নদী ড্রেজিংয়ের ফলে উত্তোলিত মাটি নদীর দুপাড়ে ফেলে জমি ভরাট করা হবে। এই জমি পরে ইপিজেড (Export Processing Zone), পরিকল্পিত বড় শিল্প এলাকা, সোলার পাওয়ার প্লান্ট এবং কৃষিভিত্তিক খামার স্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হবে, যা স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে।
৫. সোলার পাওয়ার প্লান্ট ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন: তিস্তা অঞ্চলে সোলার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো এবং স্থানীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ প্লান্ট স্থানীয় শিল্প এবং কৃষি খাতে স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।
৬. বেনারসি পল্লি ও গার্মেন্টস শিল্প স্থাপন: বন্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, শিল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি হবে। তিস্তা অঞ্চলে বেনারসি পল্লি গড়ে তোলা হবে, যা স্থানীয় কারিগরদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া সৈয়দপুর বিমানবন্দরের মাধ্যমে যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় অন্যান্য বাণিজ্যিক ও রপ্তানিমুখী শিল্প স্থাপনে সহায়তা দিলে সেখানে শিল্প স্থাপনও সহজ হবে।
৭. পরিকল্পিত ছোট ছোট ডিজিটাল শহর তৈরি: নদী ড্রেজিংয়ের ফলে উত্তোলিত মাটি নদীর দুপাড়ে ফেলে যে জমি ভরাট করা হয়, তা থেকে পরিকল্পিত ছোট ছোট শহর তৈরি করা যাবে ও সেখানের প্লট বিক্রি করে রাষ্ট্র এ প্রকল্পে যারা বিনিয়োগ করবেন তাদের মুনাফাও দিতে পারবে। যেহেতু রংপুর বিভাগীয় শহর কাছে ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক করলে এবং প্রস্তাবিত লালমনিরহাট বিমানবন্দর তৈরি হলে প্রবাসের মানুষ অনেকেই বিনিয়োগ করবেন ও সুবিধা নিতে পারবেন।
৮. বুড়ি তিস্তাসহ তিস্তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য উপনদী ও শাখা নদীকেও প্রয়োজনীয় খনন: এসব শাখা নদী ও খাল খননের মাধ্যমে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং নদীগুলোকে পরস্পর সংযুক্ত ও নির্ভরশীল থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে হড়কা বন্যা কিংবা অন্যান্য বন্যার সময় পানি পুরো অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বন্যার ক্ষতি সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে। তিস্তা নদীবক্ষের চরাঞ্চলে বসবাসকারী ও কৃষিকাজে নিয়োজিত মানুষের জীবনমান উন্নত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
৯. তিস্তা অববাহিকার সেচনির্ভর এলাকার আকার বাস্তবসম্মত রাখা: সেচ কাজের আকার ঠিক রেখে উৎপাদন ঠিক রাখা এবং প্রয়োজনে আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক কৃষিভিত্তিক খামার স্থাপনের মাধ্যমে জীবনজীবিকা নির্ভরশীলতা ও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো যাবে। তিস্তা নদীবক্ষের চরাঞ্চলে বসবাসকারী এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত মানুষের জীবনমান উন্নত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
অগ্রাধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব
তিস্তা প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে:
১. বাস্তুসংস্থান (Ecology): প্রকল্পের কার্যক্রম চলাকালীন, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
২. বিশেষজ্ঞ সম্পৃক্ততা (Expert Engagement): প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকমানের বিশেষজ্ঞদের সেবা গ্রহণ করা হবে, বিশেষ করে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের জন্য।
৩. স্থানীয় অর্থনীতি (Local Economy): প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করবে।
৪. কর্মসংস্থান (Employment): প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা যুবকদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে।
৫. ক্ষমতায়ন (Empowerment): প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে ক্ষমতায়িত করা হবে, যাতে তারা প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে।
তিস্তা প্রকল্প শুধু বাংলাদেশে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করবে না, বরং দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ প্রকল্পে স্থানীয় জনগণসহ দেশের সব স্তরের মানুষ উপকৃত হবে এবং আন্তর্জাতিক মানের ন্যায্য হিস্যা পাবে। তাই তিস্তা ইকোসিস্টেমভিত্তিক বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।
দেশের মানুষের বিনিয়োগের মাধ্যমে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের কর্মসংস্থান হবে এমনকি যদি বিদেশি এক্সপার্ট বা যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হয়, সে ক্ষেত্রে দেশের নিয়ন্ত্রণের সেসব কাজ করা সম্ভব হবে।
আজকের দিনটি আরও একধাপ এগিয়ে চলার! সরকার তিস্তা বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু আমরা যদি নিজেরা নিজেদের অর্থায়নে তিস্তা ইকোসিস্টেমভিত্তিক বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করি, তাহলে শুধু উন্নয়ন নয়, দেশের মানুষের কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক অবস্থাও উন্নত হবে।
এটি শুধু দেশের মানুষের জন্য নয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও বিশেষ সুবিধা পেতে সাহায্য করবে, বিশেষত সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও লালমনিরহাট বন্দর তৈরির মাধ্যমে। তাহলে কেন আমরা নিজেদের ক্ষমতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারব না? দেশীয় অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, আমরা শুধু আমাদের সক্ষমতা জানান দিতে পারব না, পুরো বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের শক্তি প্রদর্শন করতে পারব।
লেখক: সভাপতি, তিস্তা ফোরাম (একটি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সামাজিক উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান)
মন্তব্য করুন