বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দশ দেশের রপ্তানি আয়ের তথ্য বিশ্লেষণপূর্বক প্রণীত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে যে, উল্লিখিত দেশগুলোর মধ্যে তিনটি দেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণই শুধু ১০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। দেশ তিনটি হচ্ছে নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, যাদের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৫৭.৮৯ বিলিয়ন ডলার, ৪৫.৬৪ বিলিয়ন ডলার ও ৩৫.৪১ বিলিয়ন ডলার। এমনকি ১৬তম জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামের রপ্তানি আয়ও বাংলাদেশের চেয়ে আটগুণ বেশি। ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ৩৭৪.৬১ বিলিয়ন ডলার।
সত্য যে, ১৯৭২ সালে বিশাল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ গত সাড়ে পাঁচ দশকের ব্যবধানে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আমদানি ও রপ্তানি-ব্যয়ের চিত্র পাশাপাশি রাখলে সে পরিমাণ আর কিছুতেই উজ্জ্বল থাকে না। অর্থাৎ টাকার পরিমাণের হিসাবে রপ্তানি-আয় উল্লেখযোগ্য পরিসরে বাড়লেও আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার ফারাক অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বিবেচনায় নিলে তখন এটি অনেকটাই হতাশাব্যঞ্জক হয়ে পড়ে। আর বাংলাদেশের চেয়ে কম জনসংখ্যার এশীয় দেশ ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের দিকে তাকালে সে হতাশা তখন এতটাই প্রবল আকার ধারণ করে যে, তা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, সে উপায় খুঁজে পাওয়াটাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে শেষোক্ত এ দেশ তিনটি বাংলাদেশের চেয়ে মোটেও এগিয়ে থাকা কোনো অবস্থানে নেই। তা সত্ত্বেও পণ্য রপ্তানির দিক থেকে তারা বাংলাদেশের চেয়ে যথাক্রমে আট, ছয় ও তিনগুণ এগিয়ে থাকতে পারল কীভাবে? বৈঠকি ও জনপ্রিয় ধাঁচের আলোচনার বাইরে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব হলে বাংলাদেশের পক্ষে বিদ্যমান হতাশা কাটিয়ে এর পণ্য-রপ্তানির পরিমাণকে দ্রুতই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে তোলা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
বহুদিন থেকেই আলোচনা হচ্ছে যে, বাংলাদেশকে তার রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হলে শুধু আরএমজির ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য পণ্য রপ্তানির ব্যাপারেও উদ্যোগী হতে হবে। নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আলোচনা। কিন্তু কথা হচ্ছে, দেশের বিদ্যমান শিল্পনীতি কি তজ্জন্য বিভিন্ন সেবাধর্মী ব্যবসায়িক কার্যক্রমের বিপরীতে অন্যান্য পণ্যের উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে? মোটেও না। বরং উৎপাদন শিল্পের বিপরীতে সেবামূলক কর্মকাণ্ড সেখানে এমনসব অগ্রাধিকার পেয়ে বসে আছে যে, এ অবস্থায় কোনো উদ্যোক্তাই সেবামূলক ব্যবসার পরিবর্তে উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। এমতাবস্থায় মুখরোচক জনপ্রিয় আলোচনা বাদ দিয়ে সত্যি সত্যি যদি রপ্তানি বাড়াতে হয় তাহলে দেশের বিনিয়োগ-সংক্রান্ত নীতিকাঠামোকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। আর এটি কোনোভাবেই শুধু রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিংবা হঠাৎ হঠাৎ পিসমিল ভিত্তিতে করলে চলবে না, যেমনটি অতীতে করা হয়েছে। বরং এটি করতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্ণাঙ্গ ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও অভীপ্সাকে সামনে রেখে। তবে রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়টিকে সেখানে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সেরকম একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কতিপয় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল-প্রস্তাব নিম্নে তুলে ধরা হলো।
এক. রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের শিল্পনীতি, রপ্তানিনীতি, আমদানিনীতি, বিডার ইনভেস্টমেন্ট হ্যান্ডবুক, বেপজার ইনফরমেশন ফর ইনভেস্টর্স, বেজার ইনভেস্ট ইন ইকোনমিক জোনস, এনবিআরের বিভিন্ন রাজস্বনীতি আদেশ ও প্রজ্ঞাপন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ঋণনীতি আদেশ ও প্রজ্ঞাপন, ইপিবি ও বিপিসির বিভিন্ন রপ্তানি উন্নয়ন প্রজ্ঞাপন ইত্যাদিকে যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে একসঙ্গে পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সেখানে সেবা খাতের তুলনায় উৎপাদন শিল্পের জন্য রাষ্ট্রের নীতি-সহায়তা ও প্রণোদনাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
দুই. উল্লিখিত দলিলাদির কোনো কোনোটির কিছু কিছু ভাষ্যে যেসব পারস্পরিক অসংগতি ও অসামঞ্জস্যতা রয়েছে, যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সেসব অসংগতি ও অসামঞ্জস্যতাসমূহ দূরীভূত করে ওইসব দলিল বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বর্ধিত সমন্বয় ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। তিন. দেশের উৎপাদন সংশ্লিষ্ট খাতসমূহের উৎপাদনকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটি বিশেষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দেশে সাধারণভাবে একটি নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের যে বিষয়টি বর্তমানে অপেক্ষমাণ রয়েছে, সেটি যদি সহসা প্রণীত নাও হয় (না হওয়ার আশঙ্কাই সর্বাধিক) তাহলেও এটি প্রণয়ন করা জরুরি।
চার. উৎপাদন খাতগুলোর সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে দেশে বিভিন্ন উৎপাদন খাতের সুযোগ ও সম্ভাবনা যাচাইয়ের লক্ষ্যে অবিলম্বে একটি সমীক্ষা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে বিনিয়োগ-সম্ভাবনাময় উৎপাদন ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। আর সেসব চিহ্নিত ক্ষেত্র ও আনুষঙ্গিক তথ্যগুলো তখন অবধারিতভাবেই আগ্রহী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
পাঁচ. উৎপাদন খাতের উন্নয়ন ও প্রসারের লক্ষ্যে যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণের সময় মূল বিবেচনায় রাখতে হবে এর রপ্তানিমুখী ও রপ্তানি সামর্থ্যকে। তা রাখতে হবে এ কারণে যে, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা বিশ্বের মধ্যে অষ্টম স্থানীয় হলেও ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় এর মানুষরা বৈশ্বিক তুলনায় এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। ফলে সম্ভাবনা ও লাভজনকতার বিবেচনায় বাংলাদেশের উৎপাদন খাতের নিকট ভবিষ্যতের মূল লক্ষ্যই হতে হবে আন্তর্জাতিক বাজার। তাতে করে অনিবার্যভাবেই রপ্তানি আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে, যেমনটি ভিয়েতনামে ঘটেছে।
ছয়. যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, উৎপাদন পদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক প্রযুক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতকে অবশ্যই বৈশ্বিক মানের হতে হবে। কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে উৎপাদিত মূল বাজার হবে বিশ্বের অন্যান্য দেশ।
সাত. তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত প্রায় সমুদয় কাঁচামালই বর্তমানে আমদানিনির্ভর। ফলে এ আমদানিনির্ভরতা থেকে এ খাত মুক্ত করার লক্ষ্যে দেশে বস্ত্র শিল্পের বিকাশকে উৎসাহিত করতে হবে, যে ব্যাপারে ১৯৮০-এর দশকের গোড়াতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে প্রচণ্ডভাবে নিরুৎসাহিত করেছিল। সেদিন বিশ্বব্যাংকের সে পরামর্শ উপেক্ষা করা সম্ভব হলে এ খাতকে আজ আর প্রায় শতভাগ বৈদেশিক সূত্রের কাঁচামালের ওপর নির্ভর করতে হতো না।
আট. উৎপাদন খাত বলতে মূলত উৎপাদন-শিল্পকে বোঝানোর যে ভ্রান্তি বাংলাদেশে চালু আছে, তা থেকে বেরিয়ে এসে কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, খনিজসম্পদ ইত্যাদিকেও উৎপাদন খাতের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং উপরোক্ত সমীক্ষা ও পাঁচ বছরমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নসহ উপরোক্ত সব ক্ষেত্রেই উৎপাদন বলতে এ সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রয়োগ করতে হবে।
দেশে একটি শক্তিশালী রপ্তানিমুখী উৎপাদন খাত গড়ে তোলার জন্য ওপরে যেসব প্রস্তাব তুলে ধরা হলো, সেগুলোই এ ক্ষেত্রের শেষ কথা নয়। এর সঙ্গে আরও অনেক ধারণা, চিন্তা ও কৌশল যুক্ত করার প্রয়োজন ও সুযোগ দুই-ই রয়েছে। এ সীমিত পরিসরের লেখায় সে ধরনের বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ কম বিধায় এখানে শুধু এ-বিষয়ক প্রাথমিক চিন্তাভাবনা ও ধারণাগুলো তুলে ধরা হলো। পর এ নিয়ে আরও বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে এ প্রাথমিক প্রস্তাবগুলোর প্রতিও যদি সরকার ন্যূনতম সুদৃষ্টি দেয়, তাহলে দেশে একটি শক্তিশালী রপ্তানিমুখী উৎপাদন খাত গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তা অনেকখানি সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু চরম অমনোযোগিতায় ভরা শিল্প খাতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবে?
লেখক: অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি; সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়
মন্তব্য করুন