জগতের সব শাস্ত্রই মানুষের মঙ্গলের কথা বলে, কারণ সে মঙ্গল কামনা মানবতার মূল কথা। মানব-মঙ্গল কামনা প্রক্রিয়ায় আচার-বিধানের একটি ভূমিকা আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেই আচার-বিধান বড় কথা নয়, তার অন্তর্নিহিত বোধটিই হচ্ছে মুখ্য। অনেক সময়ই সেই বোধটুকু আমরা ধরতে পারি না, তখন আমরা তুচ্ছ জিনিসটি নিয়ে মাতি—এই যেমন শব্দের ব্যবহার, আচারের প্রকৃতি, বিধানের অনমনীয়তা ইত্যাদি। সে প্রক্রিয়ায় আমরা আসল সত্যটিকে হারিয়ে ফেলি—মানুষের মঙ্গল।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের তিনটে মাত্রিকতা আছে। প্রথমত নতুন বছরের শুরুতেই মানবিকতার চেতনা, মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য, আন্তঃধর্ম সম্প্রীতির প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা। একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে সেই চেতনা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মূল্য অনেক। বিশেষত যখন সমাজে বড় হয়ে বিভাজনই, ব্যতিক্রম নয়, নিয়ম হয়ে উঠছে মানুষে-মানুষে ভাগ-ধর্মের ভিত্তিতে, মতাদর্শের ভিত্তিতে, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। সে পরিপ্রেক্ষিতে মানবিকতা, মানবিক সৌহার্দ্য আর মানবিক সম্প্রীতির প্রতি আমাদের পুনর্ব্যক্ত করা অতি প্রয়োজন।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের দ্বিতীয় মাত্রিকতাটি হচ্ছে অভিব্যক্ত করা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আনন্দ, সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির সুখ, ধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিরাপত্তা। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য শুধু যে আমাদের ‘একের মধ্যে বহুর’ আনন্দ দেয়, তাই নয়, এটা আমাদের শক্তিও বটে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মিথস্ক্রিয়া এ দেশের বিভিন্ন জাতির নিজ নিজ সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে, বেগবান করে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজে যে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির সৃষ্টি হয়, তা মানুষের সহনশীলতা বাড়ায়, পোক্ত করে আমাদের পরমতসহিষ্ণুতাকে। একটি গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী সমাজে এসব মূল্যবোধের ভূমিকা অনেক বেশি। শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থান সমাজে একটি নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করে, একটি সামাজিক যূথবদ্ধতার জন্ম দেয়। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভাজনের বিরুদ্ধে এটা একটা শক্ত বর্মও বটে।
বাঙালি শোভাযাত্রার তৃতীয় মাত্রিকতাটি হচ্ছে সমবেত আনন্দের, উৎসবের ও উদযাপনের। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি দিক। এ দেশের সবাই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। জাতিগত বা ধর্মীয় ভিন্নতা নির্বিশেষে মানুষ এ উৎসবে যোগ দিয়ে আনন্দ করতে পারে, এ উৎসবকে উদযাপন করতে পারে। এ সার্বজনীনতাই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে একটি ভিন্নতর মাত্রিকতা দান করেছে।
এ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক আত্মসত্তা বা আত্মপরিচয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, বিরোধ নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে, আমাদের প্রত্যেকেরই বহুমাত্রিক আত্মসত্তা রয়েছে। আমাদের মধ্যে যে কোনো একজন মানুষকেই ধরা যাক না কেন। একই সঙ্গে তিনি হতে পারেন বাঙালি, মুসলমান, নারী, পেশাজীবী, মধ্যবয়স্ক, সন্তানের জননী ইত্যাদি। এসবই তার বহুবিদ আত্মপরিচয়ের নানান দিক।
এসব বহুমাত্রিক সত্তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং বাস্তবে তার এই বিভিন্ন সত্তার মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে তার এক বা একাধিক সত্তা প্রাধান্য পায়। যেমন, একজন মানুষ যখন কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, তখন তার ধর্মীয় সত্তাটিই প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি যখন একটি বৃদ্ধদের সংগঠনে যোগ দিচ্ছেন, তখন তার বয়োক্রমিক সত্তাটিই মুখ্য হয়ে উঠছে। কর্মক্ষেত্রে কিন্তু এ মানুষটিই আবার পরিচিত তার কাজের প্রকৃতি দ্বারা। অন্যদিকে তিনি যখন সন্তানদের আদর করেন, তখন তার মাতৃসত্তা বা পিতৃসত্তাই পরিস্ফুট হয়।
কোনো একটি বিশেষ আত্মসত্তা দিয়ে পরিচিত হতে কোনো দোষ নেই। একজন মানুষ যে সত্তাটি দিয়ে পরিচিত হতে চান, সেটি তিনি বাছাই করে নিতেই পারেন। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন একটি মানুষ প্রেক্ষিত নির্বিশেষে সর্বাবস্থায় একটি মাত্র আত্মপরিচয়ের ছাঁচে নিজেকে ঢেলে দেন এবং সেই আত্মসত্তাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে একটি চরম অবস্থান নেন। সে অবস্থায় একটি দ্বন্দ্ব, একটি পীড়ন, একটি বিদ্বেষ, একটি বিভাজন, একটি সংঘাত এসে উপস্থিত হয়। যে কোনো অপশক্তি তো সমাজে ওই বিভাজনটিই চায়, ওই বিদ্বেষটিই লালন করে এবং ওই সংঘর্ষের জন্যই লালায়িত হয়।
এমন একটি অপপ্রয়াসের সুযোগ আমরা দেব না। আমরা আমাদের প্রত্যেকের বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় বজায় রাখব, ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন আত্মপরিচয়ে পরিচিত হব, সবার নানান আত্মপরিচয়ের প্রতি সহনশীল ও শ্রদ্ধাবান থাকব। এ কথাগুলো প্রাসঙ্গিক কারণ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে নানান কথা বলা হচ্ছে, নানান কাজ করা হচ্ছে। কারও কারও ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়েই আপত্তি আছে। ‘মঙ্গল’ শব্দটিকে ‘আনন্দ’ শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চান কেউ কেউ। একদল মানুষের কাছে মনে হচ্ছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের অনুষ্ঠান, মুসলমানদের নয়। যদিও প্রথাগতভাবে এ শোভাযাত্রা মূলত থাকে মুখোশ ও নানান পশুপাখির প্রতিকৃতি, কেউ কেউ সেখানে মনুষ্য-ভাস্কর্য চান। পুরো অনুষ্ঠানটি যে মানুষ-উৎসারিত স্বতঃস্ফূর্ত একটি অনুষ্ঠান, সরকার সেখানে নাক গলিয়ে নানান ভাষ্য প্রদান করছে।
সুতরাং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মঙ্গল শোভাযাত্রায় সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা সবার মঙ্গল কামনা করি। কারণ ওটা আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি। ওটা আমাদের সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির প্রতীক, আমাদের উৎসবের প্রাণ। বাংলাদেশের মানুষ বিগত দিনগুলোতে মঙ্গল শোভাযাত্রা করেছে, আজও করছে, ভবিষ্যতেও করবে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং
দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন