ইদানীং সামাজিকমাধ্যমে একটি অভিনব আবদারের প্রচারণা চলছে—ড. ইউনূসকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখতে হবে। এমনকি এ লক্ষ্যে ‘মার্চ ফর ড. ইউনূস’ কর্মসূচিরও প্রচারণা চলছে। প্রচারকরা বলছে, বাংলাদেশকে ‘সঠিক পথে’ আনতে ড. ইউনূসের সরকারপ্রধান হিসেবে আরও অন্তত পাঁচ বছর থাকা দরকার। প্রচারণাটি শুরু হয় মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের দাবির পর। সম্প্রতি তিনি বাসনা ব্যক্ত করেছেন যে, ড. ইউনূসকে আরও অন্তত পাঁচ বছর সরকারপ্রধান হিসেবে দেখতে চান। এরপর থেকেই সামাজিকমাধ্যমে এ প্রচারণার শুরু। ফলে জনমনে এ ধারণা ক্রমেই প্রোথিত হচ্ছে যে, হয়তো কোনো একটি মহল নেপথ্যে থেকে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার অভিপ্রায়ে এ প্রচারণায় মদদ জোগাচ্ছে। আর সংগত কারণেই সে সন্দেহের তীর ছুটছে জাতীয় নাগরিক পার্টির দিকেই। অনেকই মনে করছেন, নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রয়োজনীয় সময় বের করার জন্য তারা এ পন্থা অবলম্বন করছে। এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর ‘রাস্তায় লোকজন বলছে, আপনারা আর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকেন’ উক্তিতে। যদিও পরে তিনি ‘থুক্কু’ দিয়ে বলেছেন, ওটা তার কথা নয়, জনগণ বলছে। তবে ‘জনগণ’ কখন, কোথায় তাকে ওই কথাটি বলেছে, তা তিনি খোলাসা করেননি। ফলে এটা অনেকের কাছেই প্রতীয়মান হচ্ছে, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ আরও অধিককাল ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী।
দেশের এক সংকটময় মুহূর্তে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ কথা অনস্বীকার্য, তখন তার প্রতি দেশবাসীর আস্থা ও সমর্থন ছিল প্রশ্নাতীত। দেশবাসীর সে বিশ্বাস ও আস্থার প্রতি সম্মান দেখিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকারের হাতে তিনি ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করবেন এমনটিই আশা করে দেশবাসী। সে প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন এবং সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছেন— এমনটি এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। তবুও একটি সন্দেহের কাঁটা জনমনে খোঁচা দিচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার পূর্বাহ্ণে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে কি না। তা ছাড়া বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোও এখনো পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেনি।
কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির কথাবার্তায় জনমনে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ-সংশয় দানা বেঁধে উঠছে। এরই মধ্যে গত ১৬ এপ্রিল বিএনপির সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু না বলায় তিনি তার পূর্ব প্রতিশ্রুাত রক্ষায় আন্তরিক কি না, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে হাস্যকর উক্তি করেছেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। বলেছেন, নির্বাচনের দুই মাস আগে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। একজন স্বল্প বুদ্ধির মানুষও জানেন দুই মাস আগে রোডম্যাপ নয়, নির্বাচনী তপশিল ঘোষণা করা হয়ে থাকে। বিএনপি যে ‘রোডম্যাপ’ চায় তা হলো কবে নাগাদ সরকার নির্বাচন দেবে তার একটি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে ‘সংস্কার-সাপেক্ষে’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় ছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু এখনো পর্যন্ত বলা হয়নি। নির্বাচন নিয়ে সরকারের এ অস্পষ্ট অবস্থান, উপদেষ্টাদের কথাবার্তা এবং এনসিপি সংগঠকদের বক্তব্য-মন্তব্যে অনেকের কাছেই প্রতীয়মান হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার তথা ড. ইউনূস হয়তো দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার অজুহাত খুঁজছেন। এ সন্দেহের প্রধান কারণ রাষ্ট্র সংস্কারের নামে গোটা ব্যবস্থা এলোমেলো করে ফেলা। কথা ছিল সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং আগামীতে যাতে ক্ষমতাসীন হয়ে কোনো দল একনায়কত্ব তথা স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে না পারে তজ্জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত সরকারের মতো এমনসব দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যেগুলোর বাস্তবায়ন দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেগুলো পুরোপুরি সম্পাদন পাঁচ-দশ বছরে সম্ভব হবে— এমনটি কেউ মনে করেন না।
রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিদের মতে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন এবং নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেওয়াই যথেষ্ট ছিল। আর সংবিধানের যেসব ধারা-উপধারা সরকারপ্রধানকে অতিশয় ক্ষমতাধর তথা একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত করে, সেসব ধারা-উপধারা সংশোধনপূর্বক সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করাই যথেষ্ট। এ বিষয়ে কমিশন যেসব সংস্কার প্রস্তাব আনবে, রাজনৈতিক দলগুলো সর্বসম্মতভাবে একমত হয়ে একটি দলিলে স্বাক্ষর করবে—পরবর্তী সংসদে তারা ওইসব সংশোধনী পাস করবে। এটা হবে জাতির কাছে তাদের অঙ্গীকার। কিন্তু তা না করে এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় মোট ১১টি সংস্কার কমিশন করে অন্তর্বর্তী সরকার এমনভাবে জট পাকিয়েছে, সে জট ছাড়ানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল বলছেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালার পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রয়োজন হতেই পারে। কেননা, আজ যেটা আবশ্যকীয় বা অনাবশ্যকীয় মনে হচ্ছে, কাল সেটা অনাবশ্যক বা অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিতে পারে। ফলে রাজনীতি অভিজ্ঞজনরা বলছেন, ড. ইউনূসের সরকার যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র সংস্কারের খাতা খুলে বসেছে, তা সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। যদিও তিনি সম্প্রতি ডিসেম্বরকে নির্বাচনের সময়সীমা ধরে সংস্কারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়েছেন। এ তাগিদ নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। প্রথমে বলা হলো, প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। একটু পরেই তার প্রেস সচিব বললেন, তিনি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। সরকারের মধ্যে এ সমন্বয়হীনতা কেন, তা সমন্বয়ক-নিয়ন্ত্রিত সরকারের কর্তাব্যক্তিরাই ভালো বলতে পারবেন। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও নাগরিক পার্টির সংগঠক সারজিস আলমের উক্তিতে যদি কারও ধারণা হয় অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফিকিরে আছে, তাহলে কি তা অসংগত হবে? বরং রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, এ সরকারের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি তাদের সংস্কার কর্মসূচি এবং সেজন্য গৃহীত পদক্ষেপেই স্পষ্ট।
প্রথিতযশা সাংবাদিক-সম্পাদক মরহুম জহুর হোসেন চৌধুরীর প্রসিদ্ধ কলাম ছিল ‘দরবার-ই-জহুর’। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসার ফিকিরের বিষয়ে তিনি যে উক্তি করেছিলেন তা আজও প্রণিধানযোগ্য। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ও উন্নয়ন ব্যবস্থার একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেন। সে রূপরেখা নিয়ে ঢাকায় সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সঙ্গে আয়োজন করেছিলেন মতবিনিময় সভার। সে মতবিনিময় সভার ঘটনা সম্পর্কে জহুর হোসেন চৌধুরী লিখেছেন—‘মার্শাল ল জারির দু’বছর পর এই ঢাকায় বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সাত্তার সাহেবের অফিস ভবনেই (পরবর্তী সময়ে সুগন্ধা) স্বনিয়োজিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব সম্পাদকদের সভায় ঘোষণা করেছিলেন, “দেশের মানুষ রাজনীতিকদের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ চায় না। উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে। দেশ দ্রুত প্রগতির পথে অগ্রসর হচ্ছে। শিগগিরই দুনিয়ার প্রথম শ্রেণীর জাতিদের কাতারে পাকিস্তান আসন গ্রহণ করবে। প্রত্যেক দিন আমি শ’য়ে শ’য়ে টেলিগ্রাম ও চিঠি পাই—‘দোহাই আপনার! রাজনীতিকদের আবার ডেকে আনবেন না।’ কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্য একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রদান করে দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের সুযোগ দেয়া হবে পাকিস্তানকে খেদমত করার”।’ এরপর জহুর হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ‘ঘটনাটা বোধ হয় ১৯৬০ সালের। বাংলার একজন সম্পাদক উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “মি. প্রেসিডেন্ট, আমিও ঐসব টেলিগ্রাম ও পত্রপ্রেরকদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আপনার রাজত্বে আমিও পরম সুখে রয়েছি এবং রাজনীতিকরা কস্মিনকালে ফিরে আসুক—একথা দুঃস্বপ্নেও আমি চিন্তা করি না। আপনি চিরকাল শান-শওকতের সঙ্গে আমাদের প্রেসিডেন্ট থাকেন এটা আমারও অন্তরের কামনা। তবে যে শাসনতন্ত্র আপনি আমাদের প্রদান করবেন তাতে একটামাত্র গ্যারন্টি চাই।” সদরে আইয়ুবের লাল টকটকে মুখ একেবারে রক্তবর্ণ ধারণ করলো। তিনি ভেবেছিলেন ব্যাটা বোধহয় মৌলিক সব অধিকার চাইবে। কিন্তু ডেঁপো সম্পাদকের নিবাস নোয়াখালী শরীফ। তিনি অত্যন্ত বিনীতভাবে নিবেদন করলেন, “আমি কেবল ঐ শাসনতন্ত্রে এই গ্যারাণ্টি চাই যে, আল্লাহ না করুন আপনি কোনোদিন স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক কোনো কারণে এই দুনিয়া যেন ত্যাগ না করেন। যদি আমাদের সে বদ কিসমত হয় তবে আপনার প্রদত্ত ঐ প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসনতন্ত্রের সুযোগে ঐ দুষ্ট রাজনীতিকদের কেউ যদি প্রেসিডেন্ট হয়ে পড়ে তবে স্যার আমরা আপনার গুণমুগ্ধ ভক্তেরা তো একেবারে দিনে-দুপুরে মারা যাবো”।’ (দরবার-ই-জহুর, দৈনিক সংবাদ, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭৮)। জহুর হোসেন চৌধুরীর এ লেখাটি পরে তার কলাম সংকলন ‘দরবার-ই-জহুর কলাম’ গ্রন্থে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। (পৃষ্ঠা: ১৪)। উল্লেখ্য, সে সম্পাদক ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী নিজেই। তিনি তখন দৈনিক সংবাদের সম্পাদক। সে অনুষ্ঠানে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, দ্য পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামসহ বিশিষ্ট সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।
সন্দেহ নেই শ্রদ্ধেয় জহুর হোসেন চৌধুরী সেদিন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করার উদ্যোগ-আয়োজন দেখে ওই ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছিলেন। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী। আর সেজন্যই যুক্তরাজ্যের ‘রয়েল মিলিটারি একাডেমি, স্যান্ডহার্টস’-এ প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসার ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাপুটে সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খানের সামনে অমন উক্তি করতে পেরেছিলেন। অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করছি, তার মতো সাহস এই অধমের নেই। তাই ওই ধরনের মন্তব্যের ধারেপাশেও না ঘেঁষে শুধু পরম দয়ালু পরওয়ারদিগারের দরবারে এ প্রার্থনা করব—‘হে দয়াময়, কারও বদ পরামর্শে আমাদের ড. ইউনূস সাহেবের যেন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দুর্মতি না হয়। তিনি যেন তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন, তুমি তাকে সে তওফিক দান করো।’
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন