শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করলেন, বৌমা তুমি কি রান্নাঘরে এনজয় করো? বৌমা আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানালেন, জ্বি মা। খুশির বদলে খেঁকিয়ে উঠলেন শাশুড়ি, এজন্যই তো তরকারি পোড়ে! হকচকিয়ে গেলেন বৌমা। তিনি তো রান্নাটা উপভোগই করেন। ভোগের আয়োজন কি উপভোগ্য হতে পারে না! ভুল কী বললেন? আর শাশুড়িইবা কী বুঝলেন! এনজয়কে ‘নির্দিষ্ট’ এক অর্থেই তিনি ব্যবহার করে থাকেন হয়তো। এরকম বোঝাপড়ায় ঘাটতি থাকলে সম্পর্কে নানা ধরনের বিপত্তি ঘটতে পারে।
জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ঘাটতিটা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। জনকল্যাণে সরাসরি নিবেদিত থাকা যায় বলে ক্ষমতাকে উপভোগ করেন অনেক রাজনীতিবিদ। বিষয়টি সহনীয় না হলে তাদের বিরুদ্ধে ভোগের অভিযোগ ওঠে। রাজনীতিবিদ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি দায়িত্বশীলদেরও সুযোগ রয়েছে ভোগ-উপভোগের। এ ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধের ওপর নির্ভর করে নাম-বদনামের।
বিশেষায়িত পেশায় এটার আশঙ্কা বেশি। আইনজীবী-সাংবাদিক-পুলিশ-চিকিৎসকের মতো পেশা সরাসরি জনসম্পৃক্ত। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দিতে হয়। মন থেকে উপভোগ করার মতো সুযোগ রয়েছে। আবার সরাসরি ক্ষমতা দেখানোও যায়। ব্যক্তির অসহায়ত্ব পুঁজি করে নিজের দম্ভ প্রকাশের অসীম সুযোগ রয়েছে। আইনের মারপ্যাঁচ, কলমের খোঁচা আর ব্যক্তির বিশ্বাসকে ধারণ করে মহান না হয়ে দানবও হয়ে ওঠে কেউ কেউ। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভোগ-উপভোগ জ্ঞান। তাদের ধারণার ওপর নির্ভর করে কোটি কোটি জনগণের জীবন-জীবিকা? তাদের রুচি ও অভ্যাসের প্রভাব পড়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ভোগবাদ থেকে বেরিয়ে পুরো জাতি অপেক্ষা করছে একটি বৈষম্যহীন দেশের নাগরিকত্ব উপভোগের জন্য। কিন্তু ১০ মাসে মন্ত্রীর বদলে উপদেষ্টা ছাড়া তেমন সংস্কার দেখছে না জনগণ। এমনকি গণঅভ্যুত্থানে জানবাজি রাখা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শুরু হয়েছে অবিশ্বাসের কাদা ছোড়াছুড়ি। একাত্তরের চেতনাকে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করত আওয়ামী লীগ। এখন চব্বিশের চেতনা নিয়ে একই অভিযোগ উঠছে এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দল ও সংগঠনের বিরুদ্ধে।
এরই মধ্যে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া একাধিক সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে নেমেছে দুদক। অভ্যুত্থানকারী কোনো কোনো ছাত্রনেতার তদবির-বাণিজ্য ও ধার করা বিলাসী জীবনের সমালোচনা হচ্ছে দেশজুড়ে। কারও কারও শারীরিক ভাষা ‘মুই কি হনু টাইপে’র। ১০ মাস আগে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া ছেলেটি এখন ব্যস্ত নিজের জীবন সাজাতে। জনসেবাকে উপভোগ করার বদলে ক্ষমতা ভোগকে মুখ্য মনে করছে। এ পারসেপশন (ধারণা) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের দল এনসিপিও গতানুগতিক রাজনৈতিক চালাকি করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে বিশ্লেষকদের কাছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখালেও পুরোনো পথেই হাঁটছে এনসিপি। কর্মী সংগ্রহ, দলীয় আদর্শ প্রচার, সর্বোপরি সাংগঠনিক তৎপরতার চেয়ে জনপ্রিয় ইস্যুতে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়ায় ঝোঁক বেশি। দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথার যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে তরুণ তুর্কিরা। কথা ভালো বললেও অভিজ্ঞতার অভাব থাকায় জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের এ আচরণকে জ্যাঠামি মনে করছে। দুজন সহযোদ্ধা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে দায়িত্ব পালন করছেন। এনসিপি বলছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এ কথা শুনে লোকে হাসে। সাধারণ মানুষ এনসিপিকে সরকারি দল মনে করে। সমালোচকরা ‘কিংস পার্টি’ বলে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নির্দলীয় ও অনির্বাচিত। গণঅভ্যুত্থানের ফসল। বিএনপি-জামায়াতসহ অভ্যুত্থানকারী সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমর্থনে গঠিত। এমনকি ১০ মাস ধরে সরকার পরিচালিত হচ্ছে তাদেরই স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায়। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এ সরকার গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে সেনাবাহিনী। তবে ‘সেনা সমর্থিত’ তকমা লাগেনি ইউনূস সরকারের পরিচিতিতে। কিন্তু সম্প্রতি করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর, সংস্কার-বিচার-নির্বাচনে ধীরগতিসহ সরকারের নানামুখী তৎপরতায় দূরত্ব বেড়েছে রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে। একপর্যায়ে হতাশ-ক্ষুব্ধ ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার পদে থাকতে চান না বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিক বৈঠক করে ড. ইউনূসের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে। পাশাপাশি নিজেদের দাবিগুলো তুলে ধরে।
ডিসেম্বরে নির্বাচন ও উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি করে বিএনপি। সংস্কারের পর দ্রুত নির্বাচন চায় জামায়াত। আগের মতোই এনসিপি সংসদের আগে গণপরিষদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন চেয়েছে। বৈঠক শেষে প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে বলেন, দেশ বড় যুদ্ধাবস্থার ভেতরে আছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য তারা সবরকম চেষ্টা করছে। এ থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বিভাজন থেকে উদ্ধার পেতে হবে এবং ঐকমত্য থাকতে হবে। সবাই একসঙ্গে বসাতে তিনি মনে সাহস পেয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন না করতে পারলে তিনি অপরাধী অনুভব করবেন। তবে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে স্পষ্ট কোনো ডেটলাইন বা রোডম্যাপ দেননি প্রধান উপদেষ্টা। বরাবরের মতোই এ বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এতে করে ঝামেলা কি মিটল? নাকি ভবিষ্যতে আরও বড় জটিলতা তৈরি হবে অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে?
গত রোববার ঢাকায় এক আলোচনা সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দেখার প্রত্যাশার কথা জানান তিনি। তারেক রহমান বলেন, ‘সরকার অবশ্যই জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য। এখানে সরকারের মান-অভিমান বা রাগ-বিরাগের কোনো সুযোগ নেই। ভোটে নির্বাচিত, অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক, নাগরিকদের গঠনমূলক সমালোচনা জারি রাখতে হবে। দেশের জনগণ সরকারের করুণার পাত্র নয়।’ তিনি বলেন, ‘শনিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।’ এ থেকে স্পষ্ট, সরকার নির্বাচনী রোডম্যাপ না দিলেও বিএনপি ডেটলাইন ঘোষণা করেছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবি আদায়ে প্রয়োজনে রাজপথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এ কথায় অনেকে বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকে। তবে গত ১৭ বছরে বিএনপির আত্মত্যাগকে ভুলে গেলে চলবে না। শীর্ষ নেতৃত্বের কারাবাস, নির্বাসন যে কোনো সময়ের চেয়ে নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে। কোটি কোটি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা, হাজার হাজার খুন, কয়েকশ গুমের ঘটনাও দমাতে পারেনি বিএনপিকে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে তাওয়া গরম করেছে তারা। একপর্যায়ে সেখানে রুটি ভাজতে সফল হয়েছে ছাত্র-জনতা। এখন তো যে কেউ রাস্তা অবরোধ করতে পারে। সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনা ও স্বৈরাচার-ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে দক্ষ বিএনপির রাজপথে সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী দুঃশাসনের মতো আন্দোলন দমনে অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই অমানবিক হবে না। এরই মধ্যে বিক্ষোভ দমনে বৈষম্যের বদনাম কুড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা না পেলেও দেশের কোথাও কোথাও বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষমতা উপভোগ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রায় চার হাজার নেতাকর্মীকে শাস্তি দিয়েও দখল এবং চাঁদাবাজি থেকে তাদের পুরোপুরি নিবৃত্ত করতে পারেনি বিএনপি। এসব দেখে প্রতিদ্বন্দ্বীরা ক্ষমতালোভী বলে তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর সুযোগ পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভাবছে, এখনই এরকম! ক্ষমতায় গেলে কী করবে? এজন্যই বুঝি দ্রুত নির্বাচন চায়। অথচ দেড় দশক ধরে মানুষ ভোট দিতে পারেনি বলেই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। শুধু বিএনপি নয়, দেশবাসীর জন্য নির্বাচন জরুরি। তবে সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে বলে একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। সে কারণেও অনেকে গোসসা হতে পারে। কিন্তু জনগণের পছন্দ জানতে চাইলে নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন ছাড়া নিজ নিজ স্বার্থে গণদাবি প্রচারণা বেশি দিন টেকে না। এখন সব দলই নিজেদের কথাকে জনগণের দাবি বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
১০ মাসের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। সংস্কার, বিচার, নির্বাচন... কীসে তাদের অগ্রাধিকার? কোনোটাই দৃশ্যমান হয়নি। উপরন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, স্থবির অর্থনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অসন্তোষে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন দানা বাঁধছে। এমনকি সুচিকিৎসার অভাবে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে জুলাই আন্দোলনের মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিকরা। এমন পরিস্থিতিতে চব্বিশের চেতনা বলে শুধু মুখে ফেনা তুললে হবে না। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের নমুনা না দেখায় সন্দেহ বাড়ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কুক্ষিগত করে দেশজুড়ে অনাচার করায় পালাতে বাধ্য হয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও একাত্তর স্বমহিমায় ফিরেছে সাধারণ মানুষের কাছে। এটা দেখে অন্তত অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি এবং জুলাই চেতনা নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে নিবৃত্ত থাকা উচিত সব পক্ষের।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন