বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল বুধবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবারের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে অংশ নিতে টোকিও সফরে গেছেন। এ সফরটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনর্জাগরণ এবং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।
ড. ইউনূস গতকাল টোকিও পৌঁছান এবং আগামীকাল শুক্রবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হবেন। বৈঠকে বাণিজ্য, অর্থনীতি, উন্নয়ন সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা, কারিগরি সহায়তা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনা হবে। সফরে ছয় থেকে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছে এবং জাপান কর্তৃক এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট সহায়তা ঘোষণার সম্ভাবনাও রয়েছে। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন বাজেটারি সহায়তা, ২৫০ মিলিয়ন রেল খাতের উন্নয়নে এবং ২৫০ মিলিয়ন অন্যান্য খাতের জন্য।
ড. ইউনূস ২৯ ও ৩০ মে টোকিওতে আয়োজিত ‘নিক্কেই ফোরাম: ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে অংশ নেবেন। সেখানে তিনি এশিয়ার ভবিষ্যৎ উন্নয়ন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন। সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, লাওসের প্রেসিডেন্ট থংলাউন সিসুলিথ, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেট, পালাউয়ের প্রেসিডেন্ট সুরাঞ্জেল হুইপস জুনিয়র এবং সিঙ্গাপুরের উপপ্রধানমন্ত্রী জেন কিম ইয়ংসহ অন্যান্য আঞ্চলিক নেতা।
ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ সফরের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের কয়েকটি মূল বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে: এক. ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ; দুই. দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা প্রভাবের ভারসাম্য; তিন. জাপানের ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক’ রণকৌশল; চার. উন্নয়ন সহযোগিতা থেকে বিনিয়োগ অংশীদারত্বে উত্তরণের জাতীয় কৌশল
জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী। জাইকার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ সহায়তা প্রতিশ্রুত করেছে। এই সহায়তার মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। সফরের সময় এ প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি এবং নতুন বিনিয়োগ চুক্তি আলোচনায় আসবে বলে জানা গেছে।
২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক সুবিধা হারাবে। এই প্রেক্ষাপটে জাপানের সঙ্গে একটি Comprehensive Economic Partnership Agreement (CEPA) বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে এরই মধ্যে জাপান CEPA স্বাক্ষর করেছে এবং এতে ওই দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ-জাপান যৌথ স্টাডি গ্রুপ, যা ২০২৩ সালে CEPA আলোচনার জন্য গঠিত হয়, এ সফরের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপরেখা চূড়ান্ত করার পথে এগোতে পারে।
জাপান দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত জোট গঠনে আগ্রহী। ভারত মহাসাগরের করিডোরে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান জাপানের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রভাব হ্রাসে জাপান বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশকে ‘Indo-Pacific Maritime Security Dialogue’-এ অন্তর্ভুক্ত করা। এ ছাড়া উপকূলীয় রাডার নেটওয়ার্ক স্থাপনের পাশাপাশি জাপানি কোস্ট গার্ডের সঙ্গে প্রশিক্ষণ সহযোগিতা। এগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলগত অংশীদারত্ব গঠনের সুযোগ।
বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (SEZs) মধ্যে আড়াইহাজার জাপান অর্থনৈতিক অঞ্চল একটি সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত। সফরের সময় আরও দুটি নতুন যৌথ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। Bangladesh Investment Development Authority (BIDA) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে—ট্যাক্স হলিডে ও ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেন্টার; ইলেকট্রিক ভেহিকল (EV), আইসিটি, কৃষিপ্রযুক্তি এবং উচ্চমূল্যের উৎপাদন খাতে বিশেষ প্রণোদনা; কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন। সফরের আলোচনাগুলো বাস্তবায়নে একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত, যাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং বেসরকারি খাত সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকে।
বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা হিসেবে একটি যৌথ নীতিপত্র—Vision 2030: Partnership Roadmap প্রকাশ প্রয়োজন, যেখানে কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অংশীদারত্বের ক্ষেত্র নির্ধারিত থাকবে।
জনসম্পৃক্ততা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য দ্বিপক্ষীয় গণমাধ্যম ও শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ানো যেতে পারে।
ড. ইউনূসের এ সফর নিছক কূটনৈতিক সফর নয়, এটি বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক কূটনীতি, কৌশলগত অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে এ সফরের আলোচনাগুলো আগামী এক দশকে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার অন্যতম কৌশলগত মডেলে পরিণত করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা আপাতত এক লাখ জনবল সেখানে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছেন। এর জন্য ভাষা প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কীভাবে ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে জনবল পাঠানো যায়, সে বিষয়ে গভীর আলোচনা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক
দৈনিক কালবেলার দুবাই প্রতিনিধি
মন্তব্য করুন