আসন্ন ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ১২ দিনের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে বলে ২৩ জুন ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এজন্য ইরান ও ইসরায়েলকে আগাম অভিনন্দন জানাতেও ভুল করেননি। কিন্তু তিনি হয়তো বুঝছেন না, পৃথিবীর মানুষ ভুল করেও মনে করে না যে, যুদ্ধটা মূলত ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে। ফলে ইরান কিংবা ইসরায়েল কোনো কিছু না বললেও ডোনাল্ড ট্রাম্প এককভাবে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি সামনে এনেছেন। তাই আমি যখন লিখছি আর প্রিয় পাঠক যখন লেখাটি পড়বেন, তার মধ্যেই ঘটে যেতে পারে এমন কিছু, যা হয়তো অনেকের ধারণারও বাইরে।
ইসরায়েলকেন্দ্রিক ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি অংশের কাছে সিংহ একটি পবিত্র ধর্মীয় সত্তা, যার নেপথ্যে রয়েছে পৌরাণিক ধর্মীয় চেতনা। সিংহকে শক্তিমত্তা, সৌম্যতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ক্ষমতার প্রতীক বিবেচনা করে ইহুদি জাতি। সেই সিংহকে স্মরণ করে অপারেশন রাইজিং লায়ন (উদীয়মান সিংহ) নামে চলমান যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েল। অন্যদিকে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইরান অপারেশন ট্রু প্রমিস-১ ও অক্টোবরে ট্রু প্রমিস-২ শেষে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার জবাবে শুরু করেছে অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩। এর আগে ইসরায়েলি আক্রমণে গাজা ভূখণ্ডে প্রায় ৫৫ হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পরও যখন মুসলিম বিশ্ব ও আরব নেতারা কার্যকর কোনো প্রতিরোধ এমনকি প্রতিবাদের ভাষাও ভুলে যায়, তখন মুসলমানদের রক্ষায় ট্রু প্রমিস-৩ (প্রকৃত ওয়াদা-৩) নামে পাল্টা যুদ্ধ শুরু করে মুসলমানদের রক্ষার জন্য ইরান এক কঠোর বার্তা দিতে চাচ্ছে। ফলে বলা চলে মধ্যপ্রাচ্যে বাঘ-সিংহের লড়াই চলছে, যে লড়াইয়ে আসলে কেউই হয়তো জয়ী হবে না আর নিশ্চিত পরাজিত হবে মানবতা।
সামরিক বিজ্ঞান বা যুদ্ধবিদ্যার ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য, বিশেষত যারা ইন্টেলিজেন্স, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, সাইবার সিকিউরিটি, একসেস কন্ট্রোল কিংবা সার্ভ্যালেন্স ও মনিটরিংয়ের মতো বিষয় চর্চা করেন, তাদের জন্য এ যুদ্ধ একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেখা যায় ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে প্রাণ হারান ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ডান হাত রূপে পরিচিত মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। এর আগে ২০১৩ সালে লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে ইসরায়েলের বিমান হামলায় মৃত্যু ঘটে ইরানের মেজর জেনারেল হাসান সাতেরির। এ ঘটনার দশ বছর পর ২০২৩ সালে সিরিয়ার দামেস্কে নিজ বাসভবনে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন ইরানের ইসলামিক রেগুলেশনারি গার্ড কোরের উপদেষ্টা সাইদ রাজি মৌসভি। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া একাধিক মিসাইলের আঘাতে ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল বিধ্বস্ত হয় সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত ইরানের দূতাবাস। সেই দূতাবাসে তখন অবস্থান করছিলেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি। এসব হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষক ও প্রশ্রয়দাতা আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দীর্ঘদিন ধরে ইরানি সরকারি স্থাপনা বিশেষত সামরিক ও পরমাণু স্থাপনায় নিবিড় গোয়েন্দা জাল বিস্তার করেছিল, আর সময়মতো তার সুফল ঘরে তুলেছে।
এরকম গোয়েন্দা কার্যক্রমের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল কিছু প্রযুক্তিপণ্য, যা ইরানের সর্বোচ্চ মহলে থাকা সেনা কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের অবস্থান প্রতিনিয়ত জানিয়ে দিত।গত ১৩ জুন (শুক্রবার) ইসরায়েলের মিসাইল হামলার প্রথম ঢেউয়ে একসঙ্গে ছয়জন সামরিক কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় পরমাণুবিজ্ঞানী সরাসরি হত্যার নেপথ্যে প্রত্যেকের কাছে থাকা কিছু পণ্যের প্রতি যেমন মোবাইল ফোন, হাতঘড়ি, চশমা, বেল্ট, বহনযোগ্য কম্পিউটার ইত্যাদির দিকে ইঙ্গিত করছেন প্রযুক্তিবিদ ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা। এসব পণ্যই শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের অবস্থান প্রতিনিয়ত জানিয়ে দিত এবং চূড়ান্ত সময়ে ইসরায়েলের ছোড়া মিসাইলকে গাইড বা দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, নিহত মেজর জেনারেল গোলাম আলি রশিদ কিছুদিন আগে অন্য একটি দেশে ভ্রমণকালে সে দেশে সেনাপ্রধান বা সামরিক স্থাপনার পক্ষ থেকে একটি হাতঘড়ি উপহার পেয়েছিলেন। মূলত সেই হাতঘড়িতে ইসরায়েল গাইড বা দিকনির্দেশনা প্রদান করার চিপস বসানো ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল আলি সামদানি, যিনিও চার দিন পর অর্থাৎ ১৭ জুন তারিখে মিসাইল হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। ফলে এ ধারণা আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ইরানের সেনা সদর বা সামরিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের অভ্যন্তরে পড়তে পড়তে অবস্থান নিয়েছে ইসরাইলের গোয়েন্দাদের এজেন্ট এবং অত্যাধুনিক পণ্য, যা ভবিষ্যতের যুদ্ধবিদ্যাকে নতুন স্তরে নিয়ে যাবে।
প্রথাগতভাবে যুদ্ধ হয় দুই দেশের সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে। একটি নির্দিষ্ট রণাঙ্গনে যুদ্ধে হতাহতদের তালিকায় সেনাসদস্যদের নামই থাকে বেশি। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রথমে ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায় হিজবুল্লাহ, হুতি ও হামাসসহ বিভিন্ন সশস্ত্র যোদ্ধার দল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অনিয়মিত ও উদ্ভাবিত কায়দায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যা প্রক্সি যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়। এরপর উভয়পক্ষ দূরপাল্লার মিসাইল বর্ষণ করে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ায়। ইরানের নিজস্ব ভূখণ্ড ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ইয়েমেন ভূখণ্ড ও সমুদ্র সীমা ব্যবহার করে ইরান আয়রনডমখ্যাত ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ডিজাইন আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়। মিডিয়ার ওপর চরম নিয়ন্ত্রণের কারণে ইসরায়েলে ধ্বংসযজ্ঞের অনেক তথ্যই অজানা রয়েছে। পক্ষান্তরে ইসরায়েল তার গোয়েন্দা বাহিনীর এজেন্টের দেওয়া তথ্য ও বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত প্রযুক্তি পণ্যের সংকেত অনুসরণ করে মিসাইল আঘাত হেনেছে সুনির্দিষ্ট ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে। ফলে ইসরায়েলের ছোড়া প্রথম ঢেউ ইরানে শীর্ষস্থানীয় সামরিক কমান্ডার ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের মৃত্যু নিশ্চিত করে, যা আগে কখনো ঘটেনি। ২০০০ কিলোমিটার দূরে থাকা দুটি দেশ কোনো সৈন্যকে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে এমন যুদ্ধের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের নতুন সংস্করণ তৈরি করেছে বলে ধারণা করা যায়। ভবিষ্যতে হয়তো মানবসৈন্যের বদলে রোবট, ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিচালিত জল, স্থল ও আকাশপথে চলাচলকারী সামরিক যান, জঙ্গিবিমান ওযুদ্ধ জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেবে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে আগ্রহী দেশসমূহ।
পৃথিবীর আদিকাল থেকেই বহু যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও ফল ঘুরিয়ে দিয়েছে এক বা একাধিক নারী। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী তার সৌন্দর্যে বিমোহিত করেই সুবিধা নিয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এবার যুদ্ধে ইরানের যাবতীয় তথ্য ও গোপন সংবাদ ইসরায়েলের হাতে তুলে দেওয়ার নেপথ্যে উচ্চারিত হওয়া এক নারীর নাম ক্যাথরিন প্যারেজ শেকেড। ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া এই নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং শিয়া অধ্যুষিত ইরানে নিজেকে একজন কট্টর শিয়াপন্থি রূপে উপস্থাপন করেন। তিনি সাংবাদিকতা ও গবেষণার আড়ালে ইরানের বিপ্লবের সাফল্যগাথা প্রচার করতে থাকেন। তার বর্ণনায় বারবার উঠে আসে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের বিষয়টি। ফলে তার পক্ষে ইরানের স্পর্শকাতর সব স্থাপনায় প্রবেশ সহজ হয়ে যায়। অন্যদিকে তিনি শিয়া চেতনা ছড়ানোর নামে মিশতেন ইরানের শীর্ষ সেনা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের পারিবারিক মহলে। শিয়া বিষয়ে তালিম বা ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণের নামে তিনি সখ্য গড়ে তোলেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের স্ত্রীদের সঙ্গে। আর এভাবেই তিনি এসব সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের সর্বশেষ অবস্থান জানতে পারতেন এবং প্রযুক্তির কল্যাণে সহজেই তা জেনে যেত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা। যার ফলে এক নারী এ যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছেন বলে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে।
১৯৬৭ সালের ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ছয় দিনের যুদ্ধ হয়েছিল ইসরাইল ও আরবদের মধ্যে। এই আরবদের মধ্যে ছিল মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার সৈন্যরা। এ তিনটি দেশই আজ যুক্তরাষ্ট্রের কবজায় এবং নানা কারণে ধ্বংসের পথে। ৫৭ বছর পর ২০২৫ সালের এই জুনে বলা যায়, মুসলিম বিশ্বের সমর্থন ছাড়াই ইরানের এই ১২ দিনের যুদ্ধে নতুন কী ইতিহাস রচনা করতে চলেছে, তা দেখার অপেক্ষায় সারা বিশ্ব।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন