শামসুল হুদা এবং সানজিদা খান রিপা
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ০৮:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশীয় বীজ ও কৃষকের ভবিষ্যৎ

দেশীয় বীজ ও কৃষকের ভবিষ্যৎ

অতিসম্প্রতি একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক কৃষি ইনপুট কোম্পানি Syngenta বাংলাদেশ সরকারের কাছে ড্রোন ব্যবহার করে কীটনাশক ও সার প্রয়োগের অনুমোদন চেয়েছে। একই সঙ্গে তারা যান্ত্রিক হারভেস্টিং সার্ভিস চালুর পরিকল্পনাও করছে। এ উদ্যোগকে একদিকে ‘স্মার্ট ফার্মিং’-এর অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, অন্যদিকে এতে কৃষিতে করপোরেট হস্তক্ষেপ, কৃষকের নির্ভরতা, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন নয়। ষাটের দশকের সবুজ বিপ্লবের সময় থেকেই উচ্চফলনশীল জাত, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়লেও, মাটির উর্বরতা হ্রাস, পানি ও মাটির দূষণ এবং জীববৈচিত্র্যের বহুমুখী ক্ষতি হয়। অঞ্চলভিত্তিকভাবে উত্তরাঞ্চলে মাটির পুষ্টিগুণ হ্রাস, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং হাওর এলাকায় পানিদূষণের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে ‘স্মার্ট ফার্মিং’-এর নামে ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং যান্ত্রিক হারভেস্টিংয়ের মতো আধুনিক প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটছে। এসব দেশীয় বীজ এবং কৃষকের ভবিষ্যৎ

প্রযুক্তি কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও, এর সঙ্গে কৃষকের আত্মনির্ভরতা হ্রাস, পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং বীজ, পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনায় করপোরেট নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়ছে।

Syngenta-র সাম্প্রতিক উদ্যোগ CENTRIGO নামের একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যান্ত্রিক হারভেস্টিং, ফসল বীমা ও বাজার সংযোগের সেবা দেওয়া হচ্ছে, যার লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে ৫০ হাজার কৃষককে এ সেবার আওতায় নিয়ে আসা। এ সেবাগুলোর সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি এগুলোর ব্যবহার কৃষকদের ক্রমবর্ধমানভাবে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির প্রযুক্তি ও পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। Syngenta-র মতো কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী বীজ, সার, কীটনাশক এবং যন্ত্রপাতির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে, যা কৃষকের স্বাধীনতা সীমিত করে এবং পরিশেষে কৃষকদের পছন্দের স্বাধীনতা লোপ পায়।

ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্ভুলভাবে কীটনাশক প্রয়োগ সময় ও খরচ কমাতে পারে এবং যান্ত্রিক হারভেস্টিং সাময়িক শ্রম সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। তবে এসব প্রযুক্তি উচ্চ খরচসাপেক্ষ, যা দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের নাগালের বাইরে। এর ফলে একধরনের ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হয়—ধনী কৃষক ও করপোরেট অংশীদাররা প্রযুক্তির সুবিধা পান, কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষকরা পিছিয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে এখনো প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষকের হাতে জমির মালিকানা নেই। ভূমিহীন কৃষকরা চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদে জড়িত, যেখানে প্রযুক্তির খরচ ও করপোরেট নির্ভরতা তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলে। যান্ত্রিক চাষাবাদে যন্ত্রপাতি, সার, বীজ এবং কীটনাশক কেনার জন্য পুঁজির প্রয়োজন হয়, যা ক্ষুদ্র কৃষকদের করপোরেট চক্রে আটকে ফেলে। ফলে ‘স্মার্ট ফার্মিং’ কার্যত ক্ষমতাবানদের জন্য মুনাফা আর দরিদ্রদের জন্য ঋণের ফাঁদে পরিণত হয়।

এ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির পরিবেশগত প্রভাব। অতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগে মাটির উর্বরতা কমে যায়, পানি দূষিত হয় এবং খাদ্যে বিষাক্ত উপাদান জমে। Soil Resource Development Institute (SRDI)-এর গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ২৭০ বর্গকিলোমিটার চাষযোগ্য জমির মাটি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, যা ঢাকা শহরের সমান (SRDI Annual Report, 2022)। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, আগামী ৬৩ বছরের মধ্যে দেশে চাষযোগ্য জমি অবশিষ্ট থাকবে না।

মাটির গুণমানের অবনতির পেছনে রয়েছে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, উচ্চফলনশীল জাতের একচেটিয়া চাষ, জমির অতিচাষ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং জৈব সারের অভাব। এসব কারণে মাটির পিএইচ স্তর, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, বোরন ইত্যাদি পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। SRDI-এর গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষিজ মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ মাত্র ১.৫ শতাংশ বা তার নিচে, যেখানে স্বাস্থ্যকর মাটির জন্য প্রয়োজন অন্তত ২.৫ শতাংশ। এসব ঘাটতি শুধু কৃষি উৎপাদন নয়, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।

একদিকে করপোরেট কোম্পানিগুলো প্রযুক্তি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্যদিকে দেশীয় বীজ, কৃষিজ্ঞান ও নারীর ভূমিকা অবমূল্যায়িত ও অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে। নারীরা বীজ সংরক্ষণের ঐতিহ্যবাহী অভিভাবক হলেও করপোরেট ব্যবস্থায় তাদের ভূমিকা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশীয় জাতের বীজ হারিয়ে যাচ্ছে এবং একক কোম্পানির পেটেন্ট করা বীজ ও ইনপুট ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা জৈববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি কৃষকের স্বাধীনতাও খর্ব করে।

জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-এ প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি উন্নয়নের কথা বলা হলেও সেখানে কৃষকের অংশগ্রহণ, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি এবং স্থানীয় জ্ঞান ও জাতের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে (ধারা ৫.১, ৫.৩)। একই নীতিতে করপোরেট নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সরাসরি সতর্কতা না থাকলেও, কৃষির সার্বজনীন কল্যাণ নিশ্চিতের নীতিগত অঙ্গীকার রয়েছে।

অন্যদিকে, বীজ নীতিমালা ২০১৮-তে দেশীয় জাত সংরক্ষণ, কৃষকের নিজস্ব বীজ উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে (ধারা ৭.১, ৭.৩)। এতে বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ বা জেনেটিকলি মডিফায়েড (GM) বীজ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। কৃষকের অধিকার রক্ষা এবং স্থানীয় বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়েছে।

প্রযুক্তি দরকার—তবে তা হওয়া উচিত কৃষকের নিয়ন্ত্রণে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই পদ্ধতিতে, করপোরেটের নয়। স্মার্ট ফার্মিংয়ের নামে আমরা যেন একটি ‘স্মার্ট করপোরেট’ ব্যবস্থার দিকে না এগিয়ে যাই, যেখানে কৃষক হয়ে পড়ে শুধু এক চুক্তিভিত্তিক কর্মী। বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে প্রযুক্তির ন্যায্য ও টেকসই ব্যবহারের ওপর, যা কৃষকের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে, পরিবেশ রক্ষা করবে, দেশীয় বীজকে সুরক্ষা দেবে এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে সবার অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে—কেবল করপোরেট মুনাফার উৎস নয়। শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন কৃষি ব্যবস্থার গণতান্ত্রিকীকরণ; যেখানে কৃষক থাকবে নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে। কৃষকের জন্য ভূমি মালিকানা, উপকরণ এবং কৃষি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে লবণাক্ততা ও খরা সহনশীল বীজ, পরিবেশবান্ধব সার এবং উন্নত জাতের প্রাণিসম্পদ উদ্ভাবনে এগিয়ে গেছেন। বিদেশি কোম্পানির ক্ষতিকর কীটনাশকের বিপরীতে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে পরিবেশবান্ধব বিকল্প কীটনাশক উদ্ভাবন করেছেন। সেচ ব্যবস্থায়ও টেকসই পদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে—নদী, খাল, বিল, জলাশয়কে পানির উৎস হিসেবে ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) উন্নত জাতের গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস ও মুরগি উদ্ভাবন করেছে। খ্যাতনামা জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী উদ্ভাবিত ‘পঞ্চব্রীহি’ ধানের জাত দেশীয় প্রযুক্তির একটি উদাহরণ হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত।

এ বাস্তবতা প্রমাণ করে, উচ্চ ফলনের জন্য করপোরেট স্বার্থ রক্ষাকারী বিদেশি বীজ, সার ও প্রযুক্তির ফাঁদে পা না দিয়ে, আমাদের নিজেদের উদ্ভাবিত ও পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তির ওপর ভরসা করাই সময়ের দাবি। দেশীয় প্রযুক্তি ও বীজ আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে—প্রয়োজন শুধু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও কৃষকদের উপযোগী করে তা বিস্তৃত করা। অতিফলনের জন্য ক্ষতিকর প্রযুক্তির হাতছানিতে সতর্ক হতেই হবে। সুতরাং বিদেশি করপোরেটের একচেটিয়া প্রযুক্তির ফাঁদ নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠুক কৃষকের জ্ঞান, দেশীয় প্রযুক্তি এবং কৃষি ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে।

লেখকদ্বয়: শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি এবং সানজিদা খান রিপা, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এএলআরডি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এক বলের আঘাতেই অনিশ্চিত তিনটি ক্লাবের ভবিষ্যৎ

মহররমে নিরাপত্তায় পাকিস্তানে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত

মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসাধারীদের খুশির খবর দিল সৌদি আরব

পঙ্গুত্বের অন্ধকারে পুলিশ সদস্য আলাউদ্দিন, পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন

কাশ্মীর ইস্যুতে সই করেনি ভারত

ঝুঁকি নিয়ে চলাচল, বাড়ছে দুর্ঘটনা

সীমান্তঘেঁষা নদী থেকে নারীর লাশ উদ্ধার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন উমামা ফাতেমা

খামেনির সঙ্গে অশোভন আচরণ বন্ধ করুন, ট্রাম্পকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

নিজ বাড়িতে ইউপি সদস্য ও ভাবিকে কুপিয়ে হত্যা

১০

ঢাকার আকাশ আজ কেমন থাকবে

১১

ইরানকে আবার হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের

১২

টিভিতে আজকের খেলা

১৩

দুপুরের মধ্যে ৭ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১৪

১২ পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে ইরান : আইএইএ

১৫

ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প সত্যিই আগ্রহী: পুতিন

১৬

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৭

মুন্সীগঞ্জে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৪

১৮

২৮ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

ভারতে আরও এস-৪০০ সরবরাহ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা

২০
X