নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কিছুতেই কাটছে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ আন্তরিক কি না, সে প্রশ্ন যেমন রয়েছে; তেমনি সংস্কার ও বিচার প্রসঙ্গ সামনে এনে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বিচার প্রসঙ্গে বলতে হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিচারকাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। বিচার কবে শেষ হবে, তা আইনি প্রক্রিয়া এবং ট্রাইব্যুনালের বিচার্য বিষয়। তবু তো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কী? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, সাড়ে দশ মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর জনপ্রশাসন, পুলিশ—কোনো ক্ষেত্রে একটি সংস্কারও সরকার করতে পারেনি। লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্বাচনের সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধের কথা বলা হয়েছে। এ সময় হিসাবে ধরে নিলে এখনো নির্বাচনের সাড়ে সাত মাস বাকি। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে অন্তর্বর্তী সরকার কী করবে আর কী করতে চায়?
আগামী ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি। আর প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হবে ৮ আগস্ট। রক্ত ঝরানো অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের দিনটি স্মরণে এরই মধ্যে ৫ আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, গত দশ মাসেরও বেশি সময় ধরে সরকার কী কী করেছে? অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আমলে লুটপাট বা চোরতন্ত্রের যে অর্থনীতি চালু হয়েছিল, তাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিল সরকারের প্রধান কাজ। এ কাজের জন্য প্রথম পাঁচ-ছয় মাস সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। তারপরও সরকার এতদিনেও ‘মব’ সহিংসতা বন্ধ করতে পারেনি। মবের সর্বশেষ উদাহরণ, বিতর্কিত নির্বাচন করার অভিযোগে ২২ জুন দুপুরে মামলা হওয়ার পর সন্ধ্যায় ‘মব’ সৃষ্টি করে সাবেক সিইসি কেএম নুরুল হুদাকে পুলিশে দেওয়া। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য নিয়ে অর্থনীতিবিদদের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার দশ মাসেও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারেনি। এ সময়ে ২৭ লাখ মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৮ লাখ নারী।
সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, সংবিধান, নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, উচ্চকক্ষ গঠন, নারী আসন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। আর এজন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ চালু রেখেছে। বেশ কিছু বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও আবার বেশ কিছু বিষয়ে এখন পর্যন্ত সমঝোতা থেকে অনেক দূরেই অবস্থান করছে। এ বিষয়গুলো নিবন্ধে আলোচনার বাইরে রেখে সংস্কারের অন্যান্য দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ছাড়াই ১২১টি সংস্কার প্রস্তাবকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে ৯টি, পুলিশ সংস্কার নিয়ে ১৩টি, জনপ্রশাসনের ১৮টি, বিচার বিভাগ সম্পর্কিত ৩৮টি এবং দুদক সংস্কার নিয়ে ৪৩টি প্রস্তাব রয়েছে। ৫টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকে উপদেষ্টা পরিষদ এ সুপারিশগুলো নিজেরা সরাসরি বাস্তবায়নের জন্য বাছাই করেছিল। কিন্তু সাড়ে তিন মাস অতিবাহিত হলেও এর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ ও দুদক কমিশনের প্রধানরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। বিচার ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানরা তাদের প্রতিবেদন জমা দেন ৫ ফেব্রুয়ারি। গত ২২ মার্চ গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এ প্রতিবেদন গ্রহণের সময় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে যেগুলো এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চাই। সেজন্য আমি চাইব সংস্কার কমিশন আশু করণীয় বা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায়—এমন সুপারিশ দ্রুত আলাদাভাবে পেশ করুক।’ সংস্কার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার এ তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যম সংস্কার প্রধান দুদিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৪ মার্চ আশু বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, এমন একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা বা প্রস্তাব জমা দেন। তিন মাসেও এর একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিওর স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা পর্যালোচনার জন্য কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। এই হচ্ছে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের হাল। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার মে মাসে বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের কাজ করছি। আরপিওসহ অনেক অধ্যাদেশের খসড়া করে দিয়েছি। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরই এগুলো বাস্তবায়ন করা যেত। কিন্তু কেন বিলম্ব হচ্ছে জানি না। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের দেরি হলে অন্যান্য বিষয় ঝুলে যাবে।’
উপদেষ্টা পরিষদ ঘোষিত ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ সংস্কারের এ হাল দেখে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নে কতটা সক্ষমতা রাখে, অথবা আদৌ হিম্মত রাখে কি না। অথচ সংস্কার নিয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টা এন্তার কথা বলে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ উপদেষ্টার নাম উল্লেখ করা যায়। সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠ। তবে গত দশ মাসে পরিবেশ নিয়ে কী কী সংস্কার হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।
এসব কারণেই প্রশ্ন উঠছে, সরকারের কোনো অংশ এবং বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল কি নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে? আর এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় থাকা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেও গত এপ্রিলে আলজাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার ভালো সমাধান।’ অথচ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কয়েক মাস পর থেকেই নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত বছর ১৯ নভেম্বর ‘অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে দ্রুতই’ জাতীয় নির্বাচনের দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেদিন তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘এটি আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। তবে একটি বিষয় বলি, আমরা এসেনশিয়াল কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব। আমরা জাস্ট চাই না, আগের মতো কোনো ভুয়া নির্বাচন হোক। আবার এটা চাই না, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কেউ আবার ভুয়া নির্বাচন করার সুযোগ পাক। এটা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নেই।’ তিনি সেদিন ‘অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পেশায় ফিরে যাওয়ার জন্য আগ্রহী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ৭ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আগামী বছর (২০২৫) আমরা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব।’ তিনি অবশ্য বলেছিলেন যে, এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত মত। এ ছাড়া অন্য কয়েকজন উপদেষ্টা ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা বলেন। পরে অবশ্য বলা হয় যে, শুধু প্রধান উপদেষ্টাই নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বলবেন অর্থাৎ নির্বাচনের সময় ঘোষণার এখতিয়ার রাখেন।
গত ৬ জুন সন্ধ্যায় দেশবাসীর উদ্দেশে ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এপ্রিলের প্রথম ভাগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণায় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি হতাশা প্রকাশ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে। এরপরই নির্বাচন প্রশ্নে হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। লন্ডন সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তারা একান্তে কথা বলেন। এরপর একটি যৌথ বিবৃতি পড়ে শোনান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। এ বিবৃতি থেকে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে এগিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচনের সময় নির্ধারণে একমত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি। তবে প্রধান উপদেষ্টা এ সময়ের মধ্যে ‘সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন’ এবং ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে’ রমজান শুরুর আগের সপ্তাহে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে বৈঠক নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল লন্ডন বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে স্বাগত জানালেও জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শুধু বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করায় অসন্তোষ প্রকাশ করে। আর অসন্তুষ্ট জামায়াত এ কারণে ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার নিয়ে দ্বিতীয় দফা সংলাপের প্রথম দিনের বৈঠক বয়কট করে। পরে জামায়াতের আমিরকে প্রধান উপদেষ্টা টেলিফোন করায় পরদিন বৈঠকে যোগ দেয় দলটি। নির্বাচনে যেতে অনেক শর্তের জাল নবগঠিত এনসিপির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—সংস্কার, বিচার ও জুলাই সনদ ঘোষণা। প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন সফরের সময় চ্যাথাম হাউসের সংলাপে জানিয়েছিলেন, আগামী জুলাই মাসে দেশের সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে জুলাই সনদ ঘোষণা করে তার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে।
লন্ডন বৈঠকে কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হলেও প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। নির্বাচন কমিশন অনেক আগে থেকেই বলে আসছে, কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুত। ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচন আয়োজন সরকার, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের ওপরই অনেকখানি নির্ভর করছে। প্রধান উপদেষ্টা আন্তরিক হলে ফেব্রুয়ারি নয়, জানুয়ারি মাসে এমনকি ডিসেম্বরেও নির্বাচন করা সম্ভব। তবে এজন্য প্রফেসর ইউনূসের আন্তরিকতার পাশাপাশি দরকার হবে, সংস্কার প্রশ্নে কিছু ছাড় দিয়ে রাজনৈতিক দল ও শক্তির অতিদ্রুত সমঝোতায় পৌঁছানো। নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ড শক্ত করে পুরোপুরি কাজে নেমে পড়তে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খুব কম সময়ের মধ্যে তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে, যা গত দশ মাসেও তারা পারেনি। তবে এই সঙ্গে আরেকটি বিষয় জরুরি, তা হচ্ছে—‘সরকারের ভেতরে সরকার’ অর্থাৎ ‘ডিপস্টেটে’র নানামুখী তৎপরতা বন্ধ করা।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন