অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ জুন ২০২৫, ০৭:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দূর দেশে বাঙালির সুর

দূর দেশে বাঙালির সুর

সিডনিতে এখন গান-বাজনার আসর নিত্যনৈমিত্তিক। দেশ-বিদেশ থেকে শিল্পীরা আসেন। গান শুনিয়ে যান। ঢাকা থেকে কলকাতা থেকে যেমন আসেন, তেমনি অন্য দেশ থেকেও আসেন। দিন কয়েক আগে গিয়েছিলাম নিউজিল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক গায়ক হিউবার্ট খোকনের গান শুনতে। তার গান আমি আগে শুনেছি কি না, মনে করতে পারছি না। তবে যে সন্ধ্যায় গানের আসরে গেলাম, সে সন্ধ্যাটি সুরের বাণীতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

সফেদ চুল আর সোম্য দর্শনের গায়ক আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা গানের স্বর্ণালি যুগে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সে সময়কাল আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির আসল সময়কাল। যার ভিত্তিতেই আমাদের শিকড়। শুরুটা হয়েছিল আমি বাংলায় গান গাই গানটি দিয়ে। সুপরিকল্পিত অনুষ্ঠানটির শুরু হয়েছিল সম্প্রতি প্রয়াত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করে। প্রতুলের অর্থ যাই হোক, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান কিন্তু অপ্রতুল। তিনি দুয়েকটি গানে আমাদের জীবন রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন। যার অন্যতম এ গানটি। আমি নিশ্চিত, যতদিন বাংলা বাঙালি ততদিন অমর থাকবে এই অবিনাশী গান।

এই অনুষ্ঠানে তারা স্মরণ করলেন প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজকে। এও আমার কাছে যেমন বিস্ময়ের, তেমনি আবেগঘন আনন্দের। যখন কবির ছবি পর্দায় ভেসে উঠেছিল, যখন তার কবিতা ‘পত্র দিও’ পাঠ হচ্ছিল; আমি শিহরিত হয়ে উঠছিলাম। ডাক্তার রশিদ আহমেদের ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আমি আমার অগ্রজ বন্ধু সংগঠক গামা আবদুল কাদিরকে কবির সঙ্গে শেষ কথোপকথনের লেখাগুলো দেখাচ্ছিলাম। প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজের সঙ্গে অন্য ধরনের এক সম্পর্ক ছিল আমার। তিনি আমাকে তুমি বললে আমি তাকে আপনি করে বলতাম। আর আমাকে তুই করে ডাকলে আমি তাকে তুমি করে বলতাম। গানের জলসায় কবিকে স্মরণ করে তারা যে উদারতা ও ভালোবাসার প্রমাণ দিলেন, তা সত্যি অসাধারণ।

হিউবার্ট খোকন আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, মান্না দের জগৎ পরিভ্রমণ করানোর সময়ও মনে পড়ছিল দুর্লভ একটি স্মৃতির কথা। তিনি যখন মান্না দের বিখ্যাত গান বাঙালির অন্তর্জগতে চিরজাগরূক ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’... গাইছিলেন; আমি তখন পঁচিশ বছর আগের এক সন্ধ্যায় ফিরে গিয়েছিলাম। ২০০০ সালে মান্না দে এসেছিলেন সিডনিতে। তখন তার বয়স আশি বছর। অধিকাংশ দর্শকশ্রোতা মনে করেছিলেন, তিনি কি আর গাইতে পারবেন? তবু তাকে দেখা, তার মুখ থেকে এক কলি গান শোনা মানেই ইতিহাস—এ আশায় যাওয়া। হলভর্তি দর্শকশ্রোতাদের মুগ্ধ করে ২৪-২৫টি গান শুনিয়েছিলেন কিংবদন্তি মান্না দে। বাংলা গাননির্ভর সে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলাম আমি। সে কারণে খুব কাছ থেকে মঞ্চে মান্না দে’কে দেখার বিরল অভিজ্ঞতা আছে আমার।

ভূপেন হাজারিকার গাওয়া দোলা হে দোলা গানটি অপূর্ব লেগেছে হিউবার্ট খোকনের কণ্ঠে। যেসব জায়গায় আবেগ আর কষ্ট সেসব জায়গায় নিপুণভাবে গেয়েছেন। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে তার আরও কিছু উদারতা আমাদের জন্য বিশেষ করে আমার জন্য ছিল চমকপ্রদ। আমরা সিডনিতে বহু খ্যাতিমান শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখি, গান শুনি। তাদের কেউই এ পর্যন্ত নিজের গান বন্ধ করে অন্য কাউকে গাইতে দিয়েছেন বলে জানি না। চোখেও পড়েনি। উপস্থাপক যখন ‘বাংলা গান কারা সামনে নিয়ে যাবে আগামীতে’ এমন প্রশ্ন করলেন, তখনই ধারণা করছিলাম তারুণ্যের কেউ হয়তো আসবে। কিন্তু তারা যে একক গান দিয়ে আমাদের মাত করে দেবে, এটা ঠাওর করতে পারিনি।

এ অনুষ্ঠানটির সঙ্গে আমার যোগসূত্র তৈরি হওয়ার কথা ছিল না। হয়েছিল ফাবিহা সিদ্দিকের কারণে। এর আগে অন্য একটি গানের জলসায় ফাবিহা বাঁশি বাজিয়েছিল। সাধারণত আমি অনুষ্ঠানে গেলে উপভোগ করে চলে আসি। হুড়োহুড়ি করে ছবি তোলা, অটোগ্রাফ নেওয়া আমার ভালো লাগে না। কিন্তু যারা আমার চিত্ত স্পর্শ করে বা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, আমি তাদের সঙ্গে দেখা করি। ফাবিহা তখন আরও ছোট ছিল। আমি অনুষ্ঠান শেষে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, একসঙ্গে ছবি তুলব বলে। সিডনির এই মেলব্যাগে তাকে নিয়ে লিখেছিলাম আমি। জানি ও অনেক দূর যাবে। ওর পথ অনেক বড়। এ আয়োজনেও ফাবিহা অতুলনীয়া। বাঁশিতে হৃদয়-মন হরণ করার পাশাপাশি হিউবার্ট খোকনের সঙ্গে আয় খুকু আয় গানটিতে ফাবিহার আবেগ আর সুরের অনুগামিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে; মুগ্ধ করেছে হলভর্তি দর্শকশ্রোতাকে।

ফাবিহা শ্রেয়া ঘোষালের যে গানটি একক গাইল, তাতে স্পষ্ট সে ভালো গায়িকা। আমি ফাবিহার মতো গুণী মেয়ে খুব কম দেখেছি। ব্যক্তিগত জীবনে সে ডাক্তার। এমন একটি শ্রমলব্ধ কঠিন বিষয়ে পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়ে এতগুলো বিষয় ধারণ করা সহজ কিছু না। সে আমাদের সিডনি বাঙালির অহংকার।

পরের জন নীলাদ্রি চক্রবর্তী। বহুদিন থেকে আমি তাকে দেখছি। তার অভিভাবক, তার পরিবারকেও চিনি আমি। এ তরুণ শুধু গান গায় না, সুর ও বাণীতে সে মানুষকে মজিয়ে রাখে। নীলাদ্রি মূলধারার এক অসামান্য প্রতিভাধর বালক। সে যন্ত্রী হিসেবেও অসামান্য। এ আয়োজনে সে যখন গান গাইছিল, আমার মনে হচ্ছিল কিশোর বা তরুণ রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন। দাড়ি-গোঁফ পোশাক মিলিয়ে এমনি এক আবহ তৈরি করা নীলাদ্রি গেয়েছিল কঠিন গান। অখিল বন্ধু ঘোষের গান গাইতে বড় বড় শিল্পীও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অথচ তোমার ভুবনে ফুলের মেলা আমি কাঁদি সাহারায় গানটি গেয়ে তাক লাগিয়ে দিল নীলাদ্রি। সেও আমাদের অহংকারের তালিকায় আছে।

যন্ত্রীদের কথা না বললেই নয়। আমি তাদের সবার নাম জানি না। তবে তবলায় অভিজিৎ দাস এই শহরের এক সুপরিচিত নাম। যার তবলা বাদন শিল্পের সঙ্গে তুলনীয়। সোহেল খান পারিবারিকভাবেই সংগীতময়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, প্রচণ্ড ঠান্ডা আর কনকনে শীত উপেক্ষা করেই মানুষজন ছুটে এসেছিলেন গান শুনতে। হিউবার্ট খোকন তাদের নিরাশ করেননি বরং আশা ও ভালোলাগায় উজ্জীবিত করে গেছেন। বিষয়টি দেশে দেশে বাঙালির শিল্পী বিনিময়ের চাইতেও অধিক। আমি বলব সংস্কৃতি ও গানের বিনিময়।

উপস্থাপক জন মার্টিন বরাবরই একজন ভালো কথক। নাটক করেন বা করতেন বলে শারীরিক ভাববিনিময়ও জানেন। তা নিয়ে সংশয় দেখি না। ডেরিক গোমেজ আর তার রিয়েল হোম প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ। তারা এমন একটি অনুষ্ঠান উপহার দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাকে, আমাদের কৃতজ্ঞ করেছেন। সানাই কিংবদন্তি ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব বলতেন, মানুষকে সুর লাগিয়ে দাও, সুর বা গান জানা মানুষ আর যাই করুক, যুদ্ধ করে না।

সত্যি তাই, যুদ্ধবিধ্বস্ত দুনিয়ায় আমি বাংলায় গান গাই অনুষ্ঠানটি আমাদের মনে শান্তির প্রলেপ দিয়ে গেছে। প্রবাসের এ শান্তি ছড়িয়ে পড়ুক দেশ-দেশান্তরে।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছড়াকার ও প্রবন্ধকার

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জুলাই যোদ্ধা ফারুকের গাল থেকে গুলি অপসারণ

ক্যানসারের চতুর্থ পর্যায়ে অভিনেত্রী তন্নিষ্ঠা

পানি পানে এই ৪ ভুল করছেন? হতে পারে ভয়াবহ বিপদ

রাবিতে নিয়োগ বোর্ড বাতিলের দাবিতে উপাচার্যের বাস ভবনের সামনে বিক্ষোভ

ভিকারুননিসায় হিজাব পরায় ২২ শিক্ষার্থীকে বের করে দিলেন শিক্ষিকা

দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ, নিহত দুই

মানুষ যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করে, অথচ কুকুরদের খাওয়ালেই যত দোষ: শ্রীলেখা

টানা ৬ ঘণ্টা ধরে জবি ভিসি ট্রেজারার প্রক্টরসহ কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ 

৫০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেবে পাকিস্তান

সাতক্ষীরায় প্রথমবারের মতো মেরুদণ্ডের জটিল অপারেশন সম্পন্ন

১০

ফজলুর রহমানকে নিয়ে ছাত্রশিবিরের বিবৃতি, বিএনপির প্রতি আহ্বান

১১

মিয়ানমারে ঐতিহাসিক রেলসেতু ভেঙে দিল বিদ্রোহীরা

১২

রিল বানাতে গিয়ে স্রোতে ভেসে গেলেন ইউটিউবার

১৩

দেশজুড়ে টানা বৃষ্টি আর কদিন চলবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৪

নেপালকে হারিয়ে জয়ের পথে ফিরল বাংলাদেশের মেয়েরা

১৫

ফ্যামিলি মেডিসিনের পথপ্রদর্শক প্রাভা হেলথের ৮ বছর পূর্তি উদযাপন

১৬

কক্সবাজারে বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আইনজীবীসহ নিহত ২

১৭

কেজিএফ নয়, আয়ের রেকর্ড তৈরি করেছিল অন্য এক সিনেমা

১৮

ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না : ধর্ম উপদেষ্টা

১৯

এবার নিজ জেলায় ফজলুর রহমানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা

২০
X